কুরিয়ারেই পচে নষ্ট হলো ১৩ লাখ টাকার আম
মাটি ও জলবায়ুর বিশেষত্বের কারণে স্বাদে অতুলনীয় বরেন্দ্র অধ্যুষিত উত্তরের জেলা নওগাঁর আম। দেশজুড়ে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় গত কয়েক বছরেই চাহিদার শীর্ষে রয়েছে এ অঞ্চলের আম। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে প্রতি মৌসুমে সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার চালিয়ে জমজমাট ব্যবসায় নেমে পড়েন উদ্যোক্তারা।
এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের কমপ্লিট শাটডাউন ও সরকারের জারিকৃত কারফিউ এসব উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। গত ১৬, ১৭ ও ১৮ জুলাইয়ে জেলার সাপাহার থেকে বুকিং দেওয়া ১৭ হাজার ৫০০ কেজি আম ডেলিভারি দিতে না পেরে ঢাকায় নষ্ট করার অভিযোগ উঠেছে ৩টি কুরিয়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে। নষ্ট হওয়া এসব আমের মূল্য কমপক্ষে ১৩ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা।
উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, আম বুকিং নেওয়ার আগে ডেলিভারি দেওয়ার অনিশ্চয়তার কথা স্পষ্টভাবে জানায়নি এসব কুরিয়ার। বুকিং চার্জের লোভে পড়ে ঝুঁকি নিয়েই আমগুলো ঢাকায় পাঠান স্টেডফাস্ট, এজেআর ও সওদাগর কুরিয়ার সার্ভিসের এজেন্টরা। এরপর নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও গ্রাহকদের কাছে আম পৌঁছায়নি কুরিয়ার। বিকল্প পথে আম পাঠানোর সুযোগ থাকলেও বিন্দুমাত্র আন্তরিকতা দেখায়নি কর্তৃপক্ষ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমএর লিমিটেড নামে একটি পেজ খুলে এ বছর অনলাইনে আম কেনাবেচার ব্যবসা শুরু করছিলেন উদ্যোক্তা মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, গত ১৬ ও ১৭ জুলাই স্টেডফাস্ট কুরিয়ায়ে সাপাহার থেকে ৫০০ কেজির অধিক আম বুকিং করেছিলাম। এর মধ্যে মাত্র ১২০ কেজি আম গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে কুরিয়ার। যেখানে অর্ধেকের বেশি আম নষ্ট অবস্থ্যায় ছিল। বাকি ৩৮০ কেজি আম পুরোটাই নষ্ট করে ফেলেছে কুরিয়ার।
তিনি বলেন, আম পৌঁছানোর সক্ষমতা না থাকার পরও বুকিং নিয়ে এভাবে তামাশা করা ঠিক হয়নি। কুরিয়ারের গাফিলতিতে আমার ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। ক্ষতিপূরণ চাইতে গেলে হাবের ম্যানেজার ঢাকায় যোগাযোগ করতে বলছেন। ঢাকার নম্বরে কল করলে কেউই রিসিভ করতে চাইছে না। পুরো মৌসুম আম বিক্রি করলে যে লাভ হতো, তার চেয়ে বেশি লোকসান গুনতে হলো।
আরেক উদ্যোক্তা উজ্জল হোসেন বলেন, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী ও নরসিংদী জেলায় পাঠানোর উদ্দেশ্যে গত ১৬ ও ১৭ জুলাইয়ে স্টেডফাস্টে ১৮৮ কেজি আম বুকিং দিয়েছিলাম। এর একটা ক্যারেটও পৌঁছাতে পারেনি কুরিয়ার। আমগুলো পুরোপুরি নষ্ট করে ফেলেছে। এতে আমার ১৮ হাজার ১৪৩ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। এখন ক্ষতিপূরণ আদায়ের উদ্দেশ্যে ঢাকায় ছুটে বেড়াচ্ছি।
তিনি বলেন, স্টেডফাস্টের ঢাকা অফিসে সরাসরি গেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করছেন। আলোচনার একপর্যায়ে অর্ধেক ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয়েছে তারা। অথচ চাইলেই স্টেডফাস্ট এসব আম বিকল্প পথে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে পারতো। মাঝখান থেকে অনেক গ্রাহকের সাথে আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক নষ্ট হলো। এর দায় সম্পূর্ণ কুরিয়ার সার্ভিসের।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্টেডফাস্ট কুরিয়ার লিমিটেডের সাপাহার হাবের ম্যানেজার হাসান চৌধুরী বলেন, গত ১৭ জুলাই ৮০০ ক্যারেট (৪০০ মণ) আম বুকিং দিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। আমবাহী গাড়ি ঢাকায় পৌঁছানোর পর সেখানে হামলা ও ভাঙচুর চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে অন্তত ২৫০ মণ আম পথেই পচে নষ্ট হয়। যেখানে উদ্যোক্তাদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ অন্তত সাড়ে ৭ লাখ টাকা।
তিনি বলেন, নষ্ট আমের বেশ কিছু অংশ বাছাই করে ঢাকায় খোলা বাজারে বিক্রির মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের কিছু ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। তবে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় সেটি আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ঢাকায় দুর্বৃত্তদের হামলায় আমাদের গাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন কর্মীও মারা গেছেন।
স্টেডফাস্ট কুরিয়ার লিমিটেডের জোনাল ম্যানেজার (নওগাঁ ও জয়পুরহাট) নুরুজ্জামান বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় গত ১৭ জুলাই সাপাহারে বুকিং নেওয়া আম উদ্যোক্তাদের ফেরত দেওয়ার জন্য নিদের্শনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানকার হাব ম্যানেজার আম ফেরতের পক্ষে ছিলেন না। তার অনুরোধের প্রেক্ষিতে ঢাকায় পাঠাতে গেলে বেশ কিছু আম নষ্ট হয়। এর দায় ওই হাব ম্যানেজারের।
উদ্যোক্তা মোনেম শাহরিয়ার নবাব বলেন, অনলাইনে আম কেনাবেচায় যারা সম্পৃক্ত তাদের বেশিরভাগই কলেজ ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গত ১৬ জুলাই থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত প্রতি মণ আম কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা দরে কিনতে হয়েছে। সেই হিসেবে ১৭ হাজার ৫০০ কেজি আমে আমাদের কমপক্ষে ১৩ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা লোকসান হয়েছে। সওদাগর কুরিয়ার ক্ষতিপূরণ দিতে চাইলেও স্টেডফাস্ট এবং এজেআর সুস্পষ্টভাবে কিছুই বলছে না। এই আর্থিক ক্ষতিতে অনেক উদ্যোক্তা মানসিক চাপে চরম বেকায়দায় পড়েছেন।
এজেআর পার্সেল অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিসের সাপাহার শাখার এজেন্ট মুমিনুল ইসলাম বলেন, গত ১৬ ও ১৭ জুলাই প্রায় ২৫০ মণ আম বুকিং হয়েছিল। বুকিং হওয়ার পর সঠিক সময়ে না পৌঁছাতে পারায় ৫০ মণ আম নষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে ২৫ মণ নষ্ট আম ডেলিভারি নিয়েছে গ্রাহকরা। বাকি ২৫ মণ নষ্ট আম কেউ ডেলিভারি নেয়নি। দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে সঠিক সময়ে আম পৌঁছাতে না পারায় উদ্যোক্তাদের অন্তত দেড় লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। এই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুযোগ আমার নেই।
সওদাগর এক্সপ্রেস সাপাহার শাখার এজেন্ট রনি চৌধুরী বলেন, গত ১৬, ১৭ ও ১৮ জুলাইয়ে উদ্যোক্তাদের থেকে বুকিং নেওয়া ৫ হাজার ৫০০ কেজি (সাড়ে ৫ টন) আম নির্ধারিত গন্তব্যে পাঠানোর আগেই নষ্ট হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা দুঃখ প্রকাশ করেছি। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা উপযুক্ত প্রমাণাদি প্রদর্শন সাপেক্ষে ক্ষতিপূরণ পাবেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সার্বিক বিষয় নিয়ে একটা সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক গোলাম মওলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমের মৌসুম শুরু হওয়ার পরপরই সাপাহারের কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের বৈঠক হয়েছিল। উদ্যোক্তাদের স্বার্থে আম বুকিং চার্জ যাতে কেউ বেশি না নেয় সে বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করা হয়। আম বুকিং নিয়ে নষ্ট করলে অবশ্যই এর দায় তাদের নিতে হবে। অভিযোগ পেলে উদ্যোক্তাদের স্বার্থে কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আলোচনা করবে জেলা প্রশাসন।
আরএআর