দক্ষিণাঞ্চলে ইন্টারনেট সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি
বরিশাল নগরীর কলেজ রোড এলাকার বাসিন্দা তরিকুল ইসলামের সংসার চলে ফ্রিল্যান্সিং করে। শুক্রবার (১৯ জুলাই) দুপুরে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে ২৮৭ ডলার ব্যয় করে একটি ক্যাম্পেইন চালু করেছিলেন। সন্ধ্যায় ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনলাইন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।
তরিকুল বলেন, ক্যাম্পেইনের অর্ডারটি বিদেশি ক্লায়েন্টের ছিল। আমার ডলার কেটে নিয়ে গেলেও ক্যাম্পেইন সম্পন্ন হয়নি। আরও কয়েকটি অর্ডার হারিয়েছি। ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছে তা চাইলেও ২-৪ বছরেও পূরণ করতে পারবো না।
শুধু তরিকুল ইসলামই নন, তার মতো ৭ থেকে ১০ হাজার ফ্রিল্যান্সার অনলাইনে খুঁজে নিয়েছেন কর্মসংস্থান। এরা সকলেই ক্ষতির মুখে। অনেকে হারিয়েছেন পুঁজি।
ইন্টারনেট সংশ্লিষ্ট কর্মজীবীদের সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করে জানা গেছে, গত ছয় দিনে বরিশাল বিভাগে ন্যূনতম এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ইন্টারনেট নির্ভর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, ফ্রিল্যান্সার, ক্যাবল অপারেটর, পরিবহন কাউন্টার রয়েছে প্রথম সারিতে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইন্টারনেট সরবারহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
বরিশাল ফ্রিল্যান্সার ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক জিহাদ রানা বলেন, আমার সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত ২০০০ সদস্য রয়েছেন। সরকার অনুমোদিত আরেকটি সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটিতে ৫০ জন আছেন। সংগঠনের বাইরে ফ্রিল্যান্সার আরও ৬/৭ হাজার রয়েছে। এরা সকলেই ক্ষতির মুখে।
তিনি বলেন, আমার প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ার বিডি নেটওয়ার্ক ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন ছয় দিনে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার নিট মুনাফা হারিয়েছে। এর মধ্যে দেখা গেছে অনেক অর্ডার সময় মতো ডেলিভারি দিতে পারিনি, অনেক অর্ডার নিতে পারিনি। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে বহির্বিশ্বে আমাদের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। কারণ টানা ছয় দিন কোনো ক্লায়েন্টের সাথে যোগাযোগ হয়নি। তারা আমাদেরকে প্রতারক ভাবলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। সুতরাং নেতিবাচক মনোভাব তৈরির ক্ষতি আর কখনো পুষিয়ে উঠতে পারব বলে মনে হয় না।
জিহাদ রানা বলেন, ইন্টারনেট সংশ্লিষ্ট সবগুলো খাত অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়েছে। অর্থের হিসেবে বিভাগে আনুমানিক এক হাজার কোটি টাকার হবে। কিন্তু মার্কেটিং পলিসিতে খ্যাতির যে ক্ষতি হয়েছে তা টাকায় পরিমাণযোগ্য নয়।
দক্ষিণাঞ্চলে ইন্টারনেট সরবারহকারী সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ইউরোটেল বিডি অনলাইন লিমিডেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক এসএম জাকির হোসেন বলেন, হঠাৎ করে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় ইন্টারনেট সংশ্লিষ্ট কর্মজীবীদের প্রতিদিন কমপক্ষে এক থেকে দেড়শ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ইন্টারনেট সরবারহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যান্ডউইথ কিনে তা ক্রেতা পর্যায়ে সরবারহ করে। ব্যান্ডউইথ কিনে ব্যবহারকারী পর্যায়ে দিতে না পারায় নিট মুনাফা হারিয়েছি আমরা।
তিনি বলেন, বরিশাল বিভাগে ব্রডব্যান্ডের দেড় থেকে দুই লাখ ব্যবহারকারী আছে বিভিন্ন কোম্পানির। ইন্টারনেট সংযোগ রক্ষণাবেক্ষণ, কোম্পানিগুলোর বেতন সবই কিন্তু বহন করতে হচ্ছে। সুতরাং আমরা যে শুধু মুনাফা হারাচ্ছি তা নয়, আনুষঙ্গিক খরচও হচ্ছে।
এসএম জাকির হোসেন বলেন, আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করব, আমাদের সহায়তা না করলে আর ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি না করা হলে আমাদের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব না।
বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) রুম্পা সিকদার বলেন, পরিবহন খাতের চেয়েও প্রযুক্তি খাতে বেশি ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে পরিবহন সংশ্লিষ্ট খাতে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে ইন্টারনেট সংশ্লিষ্ট খাতে এখনো সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। সরকারের নির্দেশনা হলে দ্রুততার সঙ্গে এই খাতে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার আওতায় নিয়ে আসা হবে।
বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) নগরী ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের ত্রুটি সারাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন সরবারহকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। এছাড়া কারফিউ শিথিল থাকায় স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে শহর ও আশপাশের এলাকার পরিবেশ। জনসমাগম বাড়ছে কর্মস্থলে। বিশেষ করে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকা উত্তোলনের মাত্রা অতিরিক্ত ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে জানা গেছে, আন্দোলনকারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে আহত ১০৫ জন এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ২৭ জন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এখনো চিকিৎসাধীন। বিভাগের মধ্যে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে একটি রেস্টুরেন্ট, ৫টি বাস কাউন্টার, পুলিশ বক্স, চৌমাথা পুলিশ বক্স, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পুলিশ ক্যাম্পে হামলা হয়েছে। এছাড়া একটি পিকআপ, একটি ট্রাক, দুটি মোটরসাইকেল, ১০টি সিসি ক্যামেরা, একজন এএসপির একটি গাড়ির গ্লাস ও একটি গণমাধ্যমের গাড়ির গ্লাস ভেঙেছে আন্দোলনকারীরা।
বরিশাল বিভাগের কোথাও সংর্ঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও বেশ কয়েকজন দেশের অন্যান্য স্থানে প্রাণ হারিয়েছেন। যাদের নিজ নিজ জেলায় গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে।
এছাড়া বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকায় পাঁচটি, জেলায় দুটি, বরগুনা ও ভোলায় একটি করে মোট ৯টি মামলা হয়েছে নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে। এতে প্রায় ৪ হাজার আসামি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে শতাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশে কমিশনার জিহাদুল কবির বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। বৃহস্পতিবার কারফিউ শিথিলের সময় বাড়ানো হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) রাতে হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট পরিষেবা। বুধবার (২৪ জুলাই) মাঝরাতে বরিশাল বিভাগের জেলা শহরগুলোতে ব্রডব্যান্ড সার্ভিস পাওয়া শুরু হলেও এখনো সীমাবদ্ধ গতি পাচ্ছেন ব্যবহারকারীরা।
আরএআর