‘মৃত্যু হাতে নিয়ে পদ্মায় ডুব দেই’
‘বাঁচা-মরার চান্স থাকে ফিফটি ফিফটি। নদীতে ডুব দিয়ে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট পানির নিচে থাকি। পানির নিচে চারপাশে তিন থেকে চার স্কয়ার ফুটের বেশি দেখা যায় না। খুব অল্প দেখায় নদীর গভীরে ব্লক ও জঙ্গলের মধ্যে হাত দিয়ে মাছ ধরতে হয়। মৃত্যু হাতে নিয়ে মাছ ধরতে পদ্মায় ডুব দেই।’
গতকাল শনিবার (২৯ জুন) দুপুরে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় পদ্মা নদীতে ডুব দিয়ে মাছ ধরতে আসা আব্দুস সোবহান। তিনি রাজশাহী নগরীর বালিয়াপুকুর এলাকার বাসিন্দা। তিনি দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে পদ্মা নদীতে ডুব দিয়ে মাছ ধরে আসছেন। সোবহানের সঙ্গে রয়েছেন আরও তিনজন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, একটি মাছ ধরা নৌকায় যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাকের চাকায় বাতাস দেওয়া গ্যাস সিলিন্ডার বসানো রয়েছে। তার পাশেই শ্যালো মেশিন চলছে। শ্যালো মেশিনের সাহায্যে কম্প্রেসারে শক্তি সঞ্চার করে তৈরি ‘অক্সিজেন’ পাইপের মাধ্যমে পানির ৪০ থেকে ৫০ ফুট নিচে পাঠানো হচ্ছে। আর সেখানে মাস্কের সাহায্যে অক্সিজেন নিয়ে মাছ ধরছেন আব্দুস সোবহান। ডুব দিয়ে বাঁধে ফেলা ব্লক ও পাথরের ফাঁকে থাকা চিংড়ি, ইঠা ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।
আব্দুস সোবহান বলেন, ১২ থেকে ১৩ বছর ধরে পদ্মা নদীতে এভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরি। শুধু মাছ ধরা নয়, অনেক সময় ডুব দিয়ে পাঙাশসহ বিভিন্ন মাছের ডিম ও পোনা আহরণের কাজ করতে হয়। পানির নিচে কোনো ঝুঁকি মনে হয় না। কোনোভাবে ওপর থেকে বাতাস সরবরাহ বন্ধ হলে প্রাণ হারানোর ঝুঁকি থাকে। অনেক সময় পাইপে প্যাঁচ পড়ে বাতাস বন্ধ হয়ে যায়। তখন মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, তিন বছর আগের কথা। রাজশাহী নগরীর ফুলতলায় মাছ ধরতে নেমেছি। সেখানে ৩০ থেকে ৩৫ ফুট পানির নিচে নেমেছিলাম। সেই হিসেবে যাওয়া-আশা মিলে প্রায় ৭০ ফুট। মাছ ধরে কোমড়ে বাঁধা বস্তায় রাখার একপর্যায়ে স্রোতের কারণে পাইপে প্যাঁচ পড়ে ওপর থেকে সরবরাহ করা অক্সিজেন বা বাতাস বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় দ্রুত শরীরের ওজন বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা লোহার শিকল খুলে কোনো মতে উঠে পড়ি। সেই ধাক্কায় প্রাণে বেঁচে যায়। সেই কথা মনে পড়লে শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
মাছ ধরে প্রতিদিনের উপার্জনের বিষয়ে আব্দুস সোবহান বলেন, কোনো দিন মাছ পাই, আবার পাই না। আবার কোনো দিন সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার মাছ ধরি। এখানে যারা কাজ করে তাদের প্রতিদিনের নির্দিষ্ট কোনো পারিশ্রমিক নেই। যে মাছ পাব সেইগুলো বিক্রি করে যে টাকা হবে তা খরচ বাদ দিয়ে সবাই ভাগ করে নিই।
জানা গেছে, এভাবে পবার শ্যামপুর, চারঘাটের ইউসুফপুরে পদ্মা নদীতে শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে কম্প্রেসারে শক্তি সঞ্চার করে তৈরি ‘অক্সিজেন’ পাইপের মাধ্যমে পানির নিচে চলে গেছে। ঝুঁকি নিয়ে ডুব দিয়ে নদীর তলদেশ থেকে মাছ ধরছেন জেলেরা। শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিন চালিয়ে কম্প্রেসারে অক্সিজেন তৈরি করে পানিতে নামছেন তারা। এভাবে মাছ ধরতে গিয়ে গত বছর দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এরপরও এমন ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরা বন্ধ হচ্ছে না।
নৌকায় কথা হয় শ্যামপুর নগরপাড়ার জেলে কাজল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ওপরে বসে নৌকা নিয়ন্ত্রণ করছি। পাশেই অপরজন নদীর তলদেশে মাছ ধরা সোবহানের সংকেতের অপেক্ষা করছে। যখন সোবহান পানির গভীরে যাবে তাকে পাইপ সরবরাহ করছেন তিনি। তবে খেয়াল রাখতে হচ্ছে পাইপে যে কোনোভাবে প্যাঁচ না পড়ে। একবার ডুব দিয়ে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট পানির নিচে মাছ ধরেন সোবহান।
তিনি আরও বলেন, নদীতে স্বাভাবিক নিয়মে কেউ জাল ফেলে আবার কেউ বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন। এতে করে তেমন মাছ পাওয়া যায় না। এ জন্য তারা বাধ্য হয়ে ডুব দিয়ে মাছ ধরার মতো ঝুঁকিপূর্ণ পন্থা বেছে নিয়েছেন। এভাবে মাছ ধরে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা। তবে পদ্মার পানি বাড়ছে। এখন জালে মাছ পড়ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ইউসুফপুরে বাঁধ এলাকায় ডুব দিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে ইউসুফপুর কারিগরপাড়া গ্রামের আবু বক্করের ছেলে জেলে আবু তালেব মিঠুর মৃত্যু হয়। ডুব দিয়ে মাছ ধরার সময় বাঁধের ব্লকে হাত আটকে তিনি আর উঠতে পারেননি। পরে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল তার মরদেহ উদ্ধার করে। একই বছরের ১২ জুন ডুব দেওয়ার পর স্ট্রোক করে মারা যান খাইরুল ইসলাম। তিনি এলাকার মৃত খবির আলীর ছেলে।
এ বিষয়ে চারঘাট উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওয়ালি উল্লাহ মোল্লা বলেন, নদীতে মাছ কমে গেছে। তারা (জেলেরা) জীবিকার তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরে। বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। গত বছর দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তাদের সচেতন করার চেষ্টা করছি।
শাহিনুল আশিক/আরএআর