ঝিনাইদহে সাড়া ফেলেছে দাদা-বৌদির রসগোল্লা চা
চায়ের কাপে চিনির বদলে দেওয়া হচ্ছে রসে টইটম্বুর রসগোল্লা। এরপর আগে থেকে তৈরি করে রাখা দুধ ও চায়ের মিশ্রণ ঢেলে তৈরি করা হচ্ছে রসগোল্লার দুধ চা। বিশেষ এই চায়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘দাদা-বৌদির রসগোল্লা চা’। এই রসগোল্লার দুধ চা বিক্রি করে প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার চরবাখরবা গ্রামের খাইরুল ইসলাম। তিনি চায়ের মধ্যে রসগোল্লা যোগ করে সৃষ্টি করেছেন নতুন স্বাদ। এই চায়ের জনপ্রিয়তাও এখন তুঙ্গে।
প্রতিদিন এই চা খেতে ঝিনাইদহের শৈলকুপার কাতলাগাড়ি বাজারে ভিড় করছে শত শত মানুষ। খাইরুল তার তিন সন্তানের শুভ, ইশান ও হুজাইফার নামে এই চা দোকান করেছেন। শুভ ইশান হুজাইফা টি স্টলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ দাদা-বৌদির রসগোল্লার চায়ের স্বাদ নিতে ছুটে আসছেন কাতলাগাড়ি বাজারে। খাইরুল ইসলাম শৈলকুপা উপজেলার শরুটিয়া ইউনিয়নের চরবাখরবা গ্রামের মো. আইয়ুব আলী শেখের ছেলে।
সরেজমিনে কাতলাগাড়ি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, শুভ ইশান হুঝাইফা টি স্টলে বিভিন্ন বয়সী মানুষ বসে আছে এক কাপ চায়ের আশায়। দোকানি খাইরুল ইসলামের বাবা, ছেলে ও এক চাচা কাতলাগাড়ি বাজার থেকে দুধ ক্রয় করে নিয়ে আসছেন, সেই দুধ আবার বড় কড়াইতে করে চা তৈরির জন্য জ্বালাচ্ছেন। খাইরুল চা বানাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। দাদা-বৌদির রসগোল্লা দুধ চা তৈরি করতে প্রথমে চায়ের কাপগুলো সুন্দর করে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিচ্ছেন। এরপর এলাচ, লবঙ্গ, কিচমিচ ও রসগোল্লা প্রতিকাপে ১টি করে, এরপর আগে থেকে তৈরিকৃত চা মিশ্রিত দুধ ঢেলে দিচ্ছেন। আবার চামচ দিয়ে নেড়ে-চেড়ে কাপের ওপর অংশে হরলিক্স দিয়ে দিলেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে দাদা-বৌদির রসগোল্লা চা। তার দোকানে দাদা-বৌদির রসগোল্লা চা ছাড়াও পাওয়া যায় ঘটি চা, স্পেশাল দুধ চা, তেঁতুল চা, মালাই চাসহ বিভিন্ন প্রকার স্পেশাল চা। আর এই স্পেশাল চা খেতে কুষ্টিয়া, যশোর, মাগুরাসহ জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন নানা বয়সের তরুণ-তরুণীরা। খাইরুলের দোকানে খেজুর চা, তেঁতুল চা, গুড় চা, মালাই চাসহ বিভিন্ন স্বাদের চা পাওয়া যায়।
এই দোকানে আসা ক্রেতারা জানান, বিভিন্ন স্বাদের চা পাওয়া যায় বলেই তারা সেখানে আসেন। এখন বেশির ভাগই আসছেন এই রসগোল্লা চায়ের টানে।
খাইরুল ইসলামের বাবা আইয়ুব আলী শেখ জানান, খাইরুল ১৯৯০ সাল থেকে চায়ের দোকান শুরু করেন বাজারের খালের পাড়ে। এরপর ২০০৩ সালে সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন ২০১৩ সাল পর্যন্ত। ওই ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেলে ২০১৩ সালে আবার একই বাজারে চায়ের দোকান করেন। চা দোকান শুরু করার পর নতুন করে শুরু করেন গরুর দুধের চা তৈরি। এরপর স্পেশাল চা বানানোর জন্য ভারতে যান। দীর্ঘ ৮ মাস ভারত থেকে স্পেশাল চাসহ বিভিন্ন আইটেমের চা বানানোয় দক্ষ হয়ে দেশে ফেরেন। ২০১৯ সালে দেশে ফিরে শুরু করেন স্পেশাল চা বিক্রি। দীর্ঘ ৫ বছরে ধরে স্পেশাল বিভিন্ন ধরনের চা বিক্রি করে অর্জন করেন খ্যাতি। খাইরুল ইসলামের তিন সন্তান, বড় ছেলে মো. শুভ আহমেদ, শিমলা খাতুন, ইশান হোসেন। শুভ বাবার চায়ের দোকানে কাজে সহযোগিতা করেন।
প্রথমে দুধ চা ১০ টাকা বিক্রি করা হতো। এখন স্পেশাল দুধটা ৪০ টাকা, ঘটিকা চা ৫০, শুধু দুধ ৩০ টাকা, মালাই চা ৫০ টাকা, কাশমিরি চা ৭০ টাকা, দাদা-বৌদির রসগোল্লা চা ৮০ টাকা, খেজুর গুড়ের চা ৫০ টাকা, দুধ কফি ৪০ টাকা, লাল কফি ২০ টাকা, লেবু চা ২০ টাকা, তেঁতুল চা ৪০ টাকা, লাল চা ৮ টাকা দরে বিক্রি করেন।
কুষ্টিয়া কুমারখালী থেকে চা খেতে আসা রিপন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলার শেষ সীমান্তে কাতলাগাড়ি এই চায়ের দোকান। এখানকার চা খেতে অনেক ভালো। বিভিন্ন জায়গায় চা খেয়েছি, কিন্তু এখানকার চা বেশি স্পেশাল। তবে দাদা-বৌদির রসগোল্লা চা সাধারণ চায়ের থেকে অনেক বেশি স্পেশাল।
শৈলকুপা থেকে আসা ফারান আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানকার চা খেতে অনেক সুন্দর। মাঝে মধ্যে একা একা আসি আবার যখন বাড়িতে কোনো মেহমান আসে তখন তাদের এই স্পেশাল চা খাওয়াতে নিয়ে আসি। এখানে সব চা স্পেশাল, তবে দাদা-বৌদির রসগোল্লা চা বেশি স্পেশাল। শুধু এই দোকানের চা ভালো তা নয়, চায়ের সঙ্গে চা দোকানি খাইরুল ভাই, তিনিও অনেক ভালো। চা খেতে আসা সবার সঙ্গে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যবহার করেন। এক কথায় তার ব্যবহারে সবাই অনেক মুগ্ধ।
কুষ্টিয়া থেকে আসা এসএম ইমরান হুসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সচরাচর তেমন একটা চা খাই না। তবে আজ বন্ধুদের সঙ্গে দাদা-বৌদির রসগোল্লা চা খেতে আসছি। কমবেশি অনেক জায়গার চা খেয়েছি। এমন চা কখনো খাইনি। এখানেই প্রথম এমন চা খেলাম। আসলে যেমন নাম তেমন তার স্বাদ।
হরিনারায়ণপুর থেকে আসা শিহাব উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চায়ের মধ্যে রসগোল্লা, কিসমিস, এলাচ, হরলিক্স দেওয়াতে স্বাদ বেড়ে যায়। চা খাওয়ার শুরুতেই স্বাদ পাই দুধ ও হরলিক্সের, এরপর রসগোল্লার, তারপর চা শেষ করে কিসমিস ও এলাচের স্বাদ পাওয়া যায়। চায়ের দামটা ৮০ টাকা হিসেবে ঠিকই আছে। এই চা শহরে খেতে গেলে এর থেকে বেশি দাম নিত।
চা দোকানি খাইরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোট থেকেই বাবার সঙ্গে চায়ের দোকানে কাজ করি। ১৯৯০ সাল থেকে নিজে দোকানে চা বিক্রি করি। ২০০৩ সালের দিকে বেচাকেনা কম হওয়ায় ঢাকায় চলে যাই, সেখানে একটি সোয়েটার ফ্যাক্টারিতে কাজ করি। ২০১৩ সালের দিকে ফ্যাক্টারি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দেশে এসে আবারো এই বাজারে ক্যানালের (খালের পাড়) ধারে চায়ের দোকান দিই। তখন থেকেই গরুর দুধের চা বিক্রি করি। দুধ চায়ের চাহিদা বাড়তে থাকায় চিন্তা করি চায়ের আইটেম বাড়ানোর। এরপর ভারতে গিয়ে দীর্ঘ ৮ মাস ধরে স্পেশাল মালাই চা, কাশিমিরি চা, দাদা বৌদির রসগোল্লা চা তৈরি করা শিখে দেশে এসে শুরু করি বিভিন্ন আইটেমের চা বিক্রি। তখন থেকে ৫ বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের চা বিক্রি করি।
তিনি বলেন, দোকানের সব চা-ই স্পেশাল, তার মধ্যে দাদা-বৌদির রসগোল্লা চা বেশি জনপ্রিয়। এছাড়া শুধু দুধ চা, মালাই চা, কাশমিরি চা, খেজুর গুড়ের চা, দুধ কফি, লাল কফি, লেবু চা, তেঁতুল চা, লাল চা বিক্রি করা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে আসেন। ভিড়ের মধ্যে সবার সঙ্গে কথা বলতে পারি না। অনেকে আবার সময় কম থাকার কারণে চা না খেয়েই চলে যান। দূর থেকে আসা চা প্রেমীদের চা খাওয়াতে না পারলে আমার মনে খুব খারাপ লাগে।
খাইরুল ইসলাম বলেন, দিনে ৪০ থেকে ৬০ কেজির দুধের চা করি। এক কেজি দুধে তিন কাপ রসগোল্লা চা তৈরি হয়। এই চা করার জন্য, আগে আগুনে ভালো করে দুধ ফুটিয়ে ঘন করতে হয়। তারপরে একটি কাপে আলাদা করে রাখা হয় দুধ এবং সর। সেখানে রাখা হয় একটি রসগোল্লা। তাতে মেশানো হয় চিনি, এলাচ, লবঙ্গ , কিসমিস এবং সামান্য পরিমাণ হরলিক্স। তারপরে চা পাতায় গরম জল মিশিয়ে তা দেওয়া হয় ওই কাপে।
তিনি বলেন, মানুষকে একটু ভিন্ন স্বাদের চা দিতেই রসগোল্লা চা করেছি। খুব অল্প দিনেই তা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই চায়ের স্বাদ অসাধারণ।
আরএআর