বড় গরু নিয়ে হতাশ খামারিরা, ক্রেতা বেশি লাখ টাকার
দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র ঈদুল আজহা। শেষ সময়ে কোরবানির জন্য পশু কেনায় ব্যস্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। সারা বছর ধরে হাজারো খামারি প্রতীক্ষায় থাকেন কোরবানির এই সময়টির জন্য। তবে কাঙিক্ষত দাম না পেয়ে মাঝারি থেকে বড় আকারের গরু পালনকারী খামারিদের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। বগুড়ায় কোরবানির পশুর হাটে আসা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমনটি জানা গেছে। তবে ছোট আকারের গরুগুলোর চাহিদা বরাবরের মতো এবারও বেশি।
বগুড়া জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এবার কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত রয়েছে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪১৫টি। যা চাহিদার চেয়ে ২৯ হাজার ১৫৫টি বেশি। কোরবানির জন্য প্রস্তুতকৃত পশুর মধ্যে রয়েছে গরু ২ লাখ ৭০ হাজার ৪১টি, মহিষ ২ হাজার ২৬৬টি। এছাড়াও ছাগল রয়েছে ৪ লাখ ২২ হাজার ২৫৭টি এবং ভেড়া ৩৯ হাজার ৮৫১টি।
গতকাল শুক্রবার (১৪ জুন) বগুড়া শহরের প্রসিদ্ধ সুলতানগঞ্জ বনানী হাটে ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে লাখো পশু হাটে ওঠে। সমাগম ঘটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের।
হাট ঘুরে দেখা যায়, দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা দামের বড় গরুর ক্রেতা কম। তবে ৭০ হাজার থেকে সোয়া লাখ টাকার গরুর ক্রেতা বেশি। এরপরের সারিতে রয়েছে দেড় লাখ থেকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকার মাঝারি আকারের গরু। দাম কম হওয়ায় অনেক খামারি গরু বিক্রি না করেই ফিরে গেছেন। এর আগে গত সোমবার এই হাট থেকে অবিক্রিত অনেক গরু ফেরত গেছে।
বিক্রেতারা জানান, পশু পালন করতে গিয়ে খাবারের খরচ বেশি হচ্ছে। প্রতি মাসে গোখাদ্যের পেছনে খামারিদের ব্যয় হয় গড়ে ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা। কিন্তু সেই অনুযায়ী প্রত্যাশিত দাম পাওয়া কঠিন। আবার সীমান্ত পেরিয়ে অনেক গরু আসায় দেশীয় গরুর চাহিদা কমে গেছে।
বগুড়ার গাবতলীর রামেশ্বরপুরের খামারি তৈয়বুর রহমান হাটে দুটি গরু নিয়ে এসেছেন। প্রতিটি গরু আড়াই লাখ টাকা দামে বিক্রি করলেও লোকসান হবে বলে দাবি করেন তিনি। ধানের গুড়া, ভুসি, ঘাস খাওয়াতে প্রতিদিন একেকটি গরুর পেছনে তার খরচ হয়েছে ৩৫০ টাকা।
তৈয়বুর বলেন, ছোট গরুর চাহিদা হাটে বেশি। যে গরু নিয়ে এসেছি দাম চেয়েছি আড়াই লাখ। কিন্তু মানুষ দাম বলছে ১ লাখ ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। অথচ আড়াই লাখ টাকায় বেচলেও খরচ উঠবে না। কারণ ভুসি, গম, খুদের দাম বেশি। এ ছাড়াও সীমান্ত দিয়ে গরু আসা দাম কমার আরেকটি কারণ।
তিনি বলেন, বর্ডার থেকে গরু না আসলেই ভালো হতো। তাহলে দেশের লোক শান্তিতে দুই একটা বেচতে পারতো। কিন্তু দেশে তো এমন আইন নেই। প্রশাসন দেখে না।
শহরের মালতিনগরের খামারি রবিউল ইসলাম ৩০ মণ ওজনের একটি ফ্রিজিয়ান জাতের ষাঁড় নিয়ে এসেছেন হাটে। দাম চেয়েছেন ৯ লাখ টাকা। তবে কাঙিক্ষত মূল্যের ধারে কাছেও কোনো ক্রেতা দাম বলছে না।
রবিউল বলেন, এটা আমার বাড়ির গরুর বাচ্চা। কোরবানিকে কেন্দ্র সাড়ে চার বছর ধরে পালন করছি। দাম বলছে পাঁচ লাখ, ছয় লাখ টাকা। এখন আরও দুই দিন আছে। এর মধ্যে বিক্রি করতে হবে।
বগুড়ার শাজাহানপুরের খোট্টাপাড়া এলাকার আল আমিন নামে এক ক্রেতা বলেন, হাটে এসে গরু দেখছি। দাম বেশি হওয়ায় এখনো পছন্দ হয়নি। কিনতে গেলে দাম বেশি, বেচতে গেলে দাম কম, এবারের কোরবানির বাজারের এমন পরিস্থিতি। হাটে ছোট গরুগুলোর দাম বেশি। তবে বড় আকারের গরুর দাম কম।
একই উপজেলার সুজাবাদ এলাকার যুবক আসাদুজ্জামান জানান, প্রতিবছরের মতো এবারও গরু কিনতে এসেছেন। হাট ঘুরে তার মনে হয়েছে গরুর দাম কম আছে।
সুলতানগঞ্জ বনানী হাটের খাস হাসিল আদায়কারী নুরুন্নবী বলেন, এবার কোরবানির মৌসুমে ছোট গরুর চাহিদা বেশি। বড় গরু খুব কম বিক্রি হচ্ছে। আশা করছি এই হাটবারে ভালো হাসিল আদায় হবে।
তিনি আরও জানান, হাটে বিক্রেতাদের জন্য লাইটিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। সার্বক্ষণিক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকছেন। এ ছাড়া জাল টাকা শনাক্তের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
হাট ছাড়াও অনেকে নিজেদের খামার থেকে গরু বিক্রি করছেন। এমনই একজন বগুড়ার শেরপুরের মান্দাইন গ্রামে অবস্থিত ‘সমতা ডেইরি অ্যান্ড এগ্রো ফার্ম’ এর মালিক মনজুরে মওলা মিল্টন। বর্তমানে তার খামারে বিভিন্ন প্রজাতির ৯৬টি পশু রয়েছে। এর মধ্যে দেশি গরু ৩০টি গরু, হোলস্টেইন ফ্রিজিয়ান ৪০টি এবং শাহীওয়াল গরু ২৬টি। এছাড়াও রয়েছে কয়েকটি মহিষও। তার খামারে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের গরু রয়েছে। এর মধ্যে কিছু গরু বিক্রি হয়েছে। কয়েকটি গরু ঢাকায় পাঠিয়েছেন বিক্রির জন্য।
মনজুরে মওলা বলেন, দানাদার খাবারের দাম এখন অনেক বেশি। শুধুমাত্র এই খাবারের ওপর ভরসা করলে খামার টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। এজন্য নিজস্ব ঘাস বা সাইলেজের ব্যবস্থা রাখতে হবে। আর বাইরে থেকে গরু আমদানি না হলে বাজার ভালো পাওয়া সম্ভব।
শেরপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. রেহানা খাতুন বলেন, আমরা সারা বছর খামারিদের কীভাবে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে গবাদিপশু পালন করে হৃষ্টপুষ্ট করা যায় সেই বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে আসছি। খামারিরা আমাদের কাছে খাদ্যের ব্যয়ের বিষয়টি জানিয়েছেন। আমরা তাদের খরচ কমানোর জন্য বিভিন্নভাবে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। এখন দানাদার খাবারের দাম বেশি। তার বদলে ঘাস ব্যবহার করে খরচ কমানো যায়। আমরা খামারিদের পরামর্শ দিচ্ছি। এক কেজি দানাদার খাবারে এখনকার বাজারে খরচ হয় প্রায় ৬০ টাকা। এক কেজি দানাদারের বদলে ১০ কেজি কাঁচাঘাস দিয়ে এই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এতে খরচ কমে আসবে প্রায় অর্ধেকের বেশি।
আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/আরএআর