যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে গৌরনদীর দধির সুখ্যাতি
ভারতের কলকাতার পূর্ব বর্ধমানের বাসিন্দা বলরাম ঘোষ প্রায়ই আসেন বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা বরিশালের গৌরনদী উপজেলায়। স্বজন-পরিচিতদের বাড়িতে বেড়ানো হয়ে গেলে যখন তল্পিতল্পাসহ কলকাতা ফেরেন তখন যে জিনিসটি নিতে কখনোই ভুল করেন না তা হলো গৌরনদীর দধি।
বলরাম ঘোষ বলেন, কলকাতায় মিষ্টান্নের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। বিশেষ করে মিষ্টি ও দধির আলাদা ঐতিহ্য আছে। কলকাতায় সাধারণত দুই ধরনের দধি হয়। সেসবের চেয়ে আমার কাছে গৌরনদীর ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারের দধি অনেক ভালো ও সুস্বাদু লাগে। গৌরনদীর দধির ঘনত্ব কলকাতার দধির চেয়ে পুরু। গৌরনদীর দধি এখনো মুখে দিলে খাটি গরুর দুধের অতুলনীয় স্বাদ জিভে লেগে থাকে। আমি যতবার এসেছি, সব কিছু ভুলে গেলেও গৌরনদীর দধি নিতে ভুল করিনি। আমার পরিবারেও এই দধির জনপ্রিয়তা ভাষায় প্রকাশের মতো নয়।
গৌরনদী হচ্ছে বরিশাল বিভাগের প্রবেশদ্বার। ঢাকা থেকে বরিশাল অভিমুখে রওয়ানা দিলে সবার প্রথম যে জনপদ আপনাকে স্বাগত জানাবে তা গৌরনদী। উপজেলাটি জেলার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এর ব্যবসায়িক সফলতার জন্য। এক সময়ে এই উপজেলার টরকি বন্দর পুরো জেলার ব্যবসায়িক কেন্দ্র ছিল। সড়ক পথের উন্নতি, টেলিকমিউনিকেশন সহজলভ্য হওয়ায় চাল, ডাল, পোশাকের জন্য সেই বিখ্যাত টরকি বন্দরের নাম ফিকে হয়ে এসেছে। কিন্তু সড়ক পথ আর টেলিকমিউনিকেশনের কারণে ব্যবসার প্রসার বেড়েছে দধির। প্রতিদিন উৎপাদনমুখী কারখানাগুলোতে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার অর্ডার আসে। ঈদ, পূজা বা বাংলা বর্ষবরণের মতো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে চাহিদা বাড়ে আরও। তখন দম ফেলার ফুরসত পান না কারিগররা।
কারিগর গোকূল চন্দ্র রায় বলেন, সারা বছরই কারখানায় দধির অর্ডার থাকে। উৎসব-পার্বন এলে অর্ডারের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। তখন আমরা খাওয়া-দাওয়ারও সময় পাই না। যেহেতু এক কেজি দধি তৈরি করতে কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টা থেকে ৯৬ ঘণ্টার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তার ওপরে গৌরনদীর দধির প্রতি মানুষের যে আস্থা তা মাথায় রেখে কষ্ট হলেও দধির মানে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। রমজানের ঈদ, কোরবানি, পূজা, পহেলা বৈশাখ এলে এক-দুই মাসের জন্য আমরা বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেই। সকাল ৮টায় কারখানায় আসি আর রাত দেড়টা বা ২টায় ঘুমাতে যেতে পারি।
সুখ্যাতির গোপন রহস্য কী?
প্রায় দুইশ বছর ধরে স্বাদ আর সুখ্যাতির শীর্ষে রয়েছে গৌরনদীর দধি। দধির জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যবসায় নেমেছেন উদ্যোক্তা, মুনাফা খাটিয়ে ফেরাচ্ছেন সচ্ছলতা। বরিশাল বিভাগ ছাপিয়ে ঢাকা, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনা, মোড়েলগঞ্জ, চট্টগ্রাম, যশোরের অসংখ্য দোকানে প্রতিদিন দধি যাচ্ছে এখান থেকে। গৌরনদী উপজেলার সবচেয়ে পুরাতন দুজন ময়রার হাত ধরে দধির সুখ্যাতি আসে। একজন সচীন ঘোষ, আরেকজন ননী ঘোষ। এর মধ্যে সচীন ঘোষ বেঁচে নেই। ননী ঘোষ এখনো ব্যবসার হাল ধরে আছেন। এই ঘোষ বংশের কারিগর রানা ঘোষ ২০০০ সালে আমেরিকায় পারি জমান। সেখানেও তিনি দধি উৎপাদন শুরু করেছিলেন।
যতদূর জানা যায়, গৌরনদীর দধির ইতিহাস অনেক পুরোনো। প্রায় আড়াই শ বছর আগে ডাওরি ঘোষ নামে এক ব্যক্তি গৌরনদীতে দধি তৈরি করে বেশ সফলতা পান। বংশ পরম্পরায় সেই ধারা ধরে রেখেছেন শচীন ঘোষ, ননী ঘোষ, গেদু ঘোষ, সুশীল ঘোষ, দিলীপ দাসসহ আরও অনেকেই।
কারখানা মালিক গৌরাঙ্গ ঘোষ বলেন, গৌরনদীর দধির ইতিহাস দুইশ বছরেরও বেশি। আমি যে দোকানটি চালাচ্ছি সেটির বয়সই ৭৫ বছর হবে। তার আগে আমার বাবা, দাদা একই ব্যবসা করেছেন। গৌরনদীর দধি জনপ্রিয় হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া আলাদা। বিভিন্ন অঞ্চলে যে দধি তৈরি করা হয় তা ৭/৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্তুত শেষ হয়ে যায়। আমাদের গৌরনদীর দধি কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টা সময় লাগে উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। সেখান থেকে খাবারের জন্য পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত করতে আরও ২৪ ঘণ্টা নির্ধারিত তাপমাত্রায় রাখা হয়।
তিনি বলেন, গ্রামের গৃহস্থের গোয়ালের গরু থেকে আমাদের সরবরাহকারীরা দুধ দোহন করে নিয়ে আসেন। তার ঘনত্ব পরীক্ষা শেষে বড় কড়াইতে ১০০ ডিগ্রিরও বেশি তাপমাত্রায় ফুটাতে হয়। সকাল ৮টা থেকে শুরু করে রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত জ্বাল দিয়ে তারপর ঘন দুধ নামিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তা ঠান্ডা করে তাতে পরিমাণ মতো চিনি দিয়ে আবারো উনুনে উঠিয়ে জ্বাল দেওয়া হয়। এরপর তা নামিয়ে হাড়িতে ঢেলে প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা করার জন্য রাখা হয়। ঠান্ডা করার পর সেই হাড়িভর্তি দধি চুলার অল্প আঁচে রাখা হয় ৬-৭ ঘণ্টা। সেখান থেকে নামিয়ে আবারও ২৪ ঘণ্টার জন্য ঠাণ্ডা করতে রাখা হয়।
আরেক কারখানা মালিক শ্যামল চন্দ্র ঘোষ বলেন, দধিতে স্বাদ আনতে এত দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমাদের কারখানার বয়সও ৭০-৭৫ বছর হবে। বাবাকে দেখেছি স্বাদ ও সুখ্যাতি ধরে রাখতে খাঁটি দুধ কিনতে কখনো কার্পণ্য করেননি। তিনি এখনো এই ব্যবসার প্রধান। তার নির্দেশনা অনুসারেই আমরা ব্যবসায় সফলতা পেয়েছি। সারাদিন দধি কিনতে দোকানে লোকজন ভিড় করে থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অর্ডার আসে।
পুরাতন ব্যবসায়ী ননী ঘোষ বলেন, গৌরনদীর দধির স্বাদ আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। তারপরও যা আছে তা দেশের অন্য কোনো দধির নেই। স্বাদ কমার কারণ হচ্ছে আগে দেশি গরুর দুধ পাওয়া যেত। এখন সব খামারের গরুর দুধ। দেশি গরুর প্রধান খাবার হচ্ছে ঘাস। কিন্তু খামারে কৃত্রিম খাবার খাওয়ানো হয়।
কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা
গৌরনদী উপজেলায় বেশ কয়েকটি স্থানে দধি উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ননী ঘোষের গৌরনদী ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার আর সচীন ঘোষের গৌরনিতাই মিষ্টান্ন ভান্ডার সবচেয়ে বড় আর নামকরা। এই কারখানায় দধির পাশাপাশি শুকনা মিষ্টি, রসগোল্লা, রস মালাই, ক্ষীরপুরি, রসমঞ্জুরী, চমচম, কালোজাম, সন্দেশ ও বালুশাহ্সহ ১৪ প্রকারের মিষ্টিজাত খাদ্যপণ্য তৈরি হয়। গ্রাম থেকে দুধ সংগ্রহকারী, কারখানার সহযোগী, কারিগর, বিপনন মিলিয়ে দুটি কারখানায় দুই শতাধিক জনবল কাজ করেন।
খোকন হাওলাদার নামে এক কর্মী বলেন, আমি গ্রামে গ্রামে হেঁটে দুধ সংগ্রহ করে কারখানায় দেই। এই কাজ করে আমার সংসার চলে। কারখানা না থাকলে আমার বেকার থাকতে হতো।
আরেক কর্মী রাজ্জাক হাওলাদার বলেন, দধির কারখানা চালু থাকায় বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাজের ব্যবস্থা হয়েছে। দধি উৎপাদন কারখানা কেন্দ্রিক কাজে অন্তত এলাকার মানুষ ভালো আছি। কাজের জন্য আমাদের দূর-দূরান্তে যেতে হয় না। অল্প হলেও কর্মসংস্থানের যে ব্যবস্থা হয়েছে তা সবার জন্য ভালো।
মিন্টু হাওলাদার নামে এক কর্মী বলেন বলেন, গৌরনদীর উন্নতির পেছনে দধির ব্যবসার বড় অবদান। এই অঞ্চলকে মানুষ এখন দধির জন্য গুরুত্ব দেয়।
জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দাবি
স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষক রাশিদা খানম বলেন, গৌরনদীর দধি, মিষ্টি, স্বাদে অসাধারণ। যুগ যুগ ধরে খাচ্ছি। কিন্তু এর স্বাদের কমতি হয়নি। বাবা-দাদার হাত ধরে যখন মিষ্টি খেতে আসতাম তখন যে স্বাদ ছিল এখনো দধি মুখে দিলে সেই আদি স্বাদ সুন্দর অনুভূতি দেয়। গৌরনদীর দধি দেশ ও দেশের বাইরে তার স্বনামে বিখ্যাত। এই দধিটির জিআই স্বীকৃতির দাবি জানাচ্ছি।
স্থানীয় বাসিন্দা জিএম জসীম হাসান বলেন, ১৫০ টাকা কেজি দরে দধি পাওয়াটা কিন্তু অনেক সাশ্রয়ী। এই দধি আমাদের উপজেলা, এই জনপদকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যাচ্ছে। সরকারের কাছে আবেদন গৌরনদীর দধিকে জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণা করে যেন গৌরনদীর ঐতিহ্যবাহী এই ব্যবসাকে সম্মানিত করা হয়।
আরএআর