উপকূলে ‘সাগরে খাওয়া’ পরিবারে অপেক্ষার রক্তক্ষরণ
>> সাত বছরে হতাহত প্রায় ৫০০ জেলে
>> সন্ধানে তোড়জোড় নেই স্থানীয় প্রশাসনের
>> ট্রলার মালিকের কাছে জিম্মি জেলেরা
‘আমার কোনো সম্পদ লাগবে না, আমার কইজ্জার (কলিজা) ধন পোলাডা ফেরত আইলেই হইবো’- বলতে বলতেই হাউমাউ করে অঝোরে কাঁদলেন তারাবানু। বাড়িতে কোনো অচেনা মানুষ এলেই মনে করেন তার ছেলের সন্ধান নিয়ে এসেছেন। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে জানতে চান, ‘আমার ইউনুস কোতায় আচে, কেমন আচে ইউনুস, বাড়িত আইবে কবে?’
শুধু বাড়িতেই নয়, জেলা শহরের যতগুলো সরকারি অফিস রয়েছে ছেলের ছবি নিয়ে সবখানে ধরনা দিচ্ছেন নিয়ম করে। প্রতিবেশী যারা আছেন তাদের কাছে সব সময় ছেলে ইউনুসের গল্পই বলেন।
বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের মঠখালী গ্রামের বাসিন্দা তারাবানু। জীর্ণ সংসারের একমাত্র উপার্জনের উৎস ছিল ছেলে ইউনুস। মৌসুমে বড় ট্রলারে মাছ ধরতে গভীর সমুদ্রে পারি দিতে হতো। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে বেড়িয়েছিলেন ইউনুস। ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় মিধিলি আঘাত হানার পর মঠখালী গ্রামের যে চারজন জেলে আজও বাড়ি ফেরেনি তাদের মধ্যে একজন ইউনুস। দিন যত যাচ্ছে ছেলে ফিরে না আসার দুশ্চিন্তায় ততই অস্বাভাবিক হয়ে উঠছেন ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধা।
শুধু বরগুনার ইউনুসই নন, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালীর নদী তীরের গ্রাম ঘুরলে এমন হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা অজস্র শোনা যায়। মাছ ধরতে বেড়িয়ে নিখোঁজ বা মারা যাওয়াকে স্থানীয়রা বলেন ‘সাগরে খাইছে’। কেউ সন্তানের জন্য অপেক্ষা করছেন, কেউ বাবার জন্য বা কেউবা স্বামীর জন্য। তারাবানু যেমন জানেন না তার অপেক্ষা আর কোনো দিন ফুরাবে কিনা, তেমনি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর অপেক্ষার রক্তক্ষরণ দক্ষিণাঞ্চলের চরের নিখোঁজদের পরিবারের। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি হারিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শুধু একটি নিখোঁজ সংবাদই আসে না পাশাপাশি কয়েকটি পরিবার অচল হয়ে পড়ে। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় সন্তানদের জীবন।
এদিকে সাগরে গিয়ে নিখোঁজ জেলেদের সন্ধানে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর তৎপরতা নিয়েও প্রশ্ন আছে পরিবারবগুলোর।
ভোলার মনপুরা উপজেলার ৪ নং দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের আব্দুল মোতালেবের ছেলে সুমন সাগর থেকে ফেরেনি আট মাসেও। শুধু সুমন নয়, মনপুরার ২০ জেলের সন্ধান মেলেনি আজও।
সুমনের বাবা আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘আমাগো গেরামে গরু চুরি হইছিল। গরু চুরির কেচ্চা উদ্ঘাটনে তিন দফায় পুলিশ আইছিল যে। আমার পোলা গ্যালো, ট্রলারশুদ্ধ কুঁড়িডা মানুষ নিখোঁজ। একফিরও পুলিশ-প্রশাসন আমগো খোঁজ নিল না। আমগো জীবনের মূল্য কি গরুর চাইতেও কম?’
২০২৩ সালের অক্টোবরে আবহাওয়া অফিস পূর্বাভাস দিচ্ছিল ঘূর্ণিঝড় হামুনের। কিন্তু দক্ষিণ সাকুচিয়ার সমুদ্রগামী ট্রলার রিনা-১ এর মালিক আক্তার মাঝি তার ২০ মাঝিকে জোর করেই ২৩ অক্টোবর সাগরে পাঠান। পরের দিন ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় হামুন আঘাত হানার পর থেকেই রিনা-১ ট্রলারের সবাই নিখোঁজ।
স্বজনরা বলছেন, জেলেরা সংকেত নামার পর যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আক্তার মাঝি প্রশাসন ম্যানেজ করে ট্রলার নিয়ে সাগরে যেতে বাধ্য করেন জেলেদের। ২৪ অক্টোবর সাগরে থাকা এসব জেলেদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা আর জানা সম্ভব হয়নি। তারা জীবিত না মৃত তাও এখনো জানতে পারেননি স্বজনরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপার্জনক্ষম এসব জেলেরা ফিরে না আসায় দিশাহারা অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন পরিবারের লোকজন।
আরও পড়ুন
নিখোঁজ আলাউদ্দিন মাঝির স্ত্রী পারভিন বেগম বলেন, ‘সংসারে সাত মুখ। রোজগারের লোক আছিলেন উনি (আলাউদ্দিন)। সাগরে খাওয়ার পরে আমাগো ঘরে ঠিকমতন চুলা জ্বলে না। অভাব অনটনে কী কষ্টে আছি তা কইতে পারমু না। মহিলা মানুষ হইয়্যা ক্যামনে সংসার চালামু জানি না, সংসারে যে ট্যাকা দিতো হেইতো ফিররা আইলো না।’
দক্ষিন সাকুচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অলিউল্লাহ কাজল বলেন, নিখোঁজ জেলেদের সন্ধান পেতে এখনো প্রচেষ্টা চলছে। পরিবারগুলো যেন চলতে পারে সেজন্য ট্রলার মালিকের পক্ষ থেকে ৬০ হাজার করে ১২ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। ঝড়ের কবলে পরে নিখোঁজ জেলেরা ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কায় আশ্রয় নিয়েছে কিনা তা জানার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে দূতাবাসগুলোতে যোগোযোগ করা হয়েছে।
সরকারি প্রতিবেদন যা বলছে
ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূল বিশেষ করে নদী তীরবর্তী চরের বাসিন্দারা মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকেন। তেমনি নদী বা সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরাও মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেন। বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, প্রতি বছরই ঝড় জলোচ্ছ্বাসে নির্দেশনা অমান্য করে বহু জেলে নিখোঁজ ও প্রাণহানির শিকার হন।
বরিশাল বিভাগীয় মৎস অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই সাত বছরে ২৫৯ জেলে নিহত হয়েছেন। এছাড়া ১৭২ জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। যাদের কোনো সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, যাদের মরদেহ পাওয়া যায় তাদের নিহতের তালিকাভুক্ত করা হয়। আর যাদের মরদেহ পাওয়া যায়নি তাদের নিখোঁজ তালিকাভুক্ত করা হয়। সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে ২০১৬ সালে ৭৭ জন। নিখোঁজ হয়েছেন ২০১৮ সালে ৬২ জন।
তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৭ সালে ১২ জন, ২০১৮ সালে ১৮ জন, ২০১৯ সালে ৩৮ জন, ২০২০ সালে ৫৭ জন, ২০২১ সালে ৩৯ জন ও ২০২২ সালে ১৮ জন নিহত হয়েছেন।
নিখোঁজ হয়েছেন- ২০১৬ সালে ১০ জন, ২০১৭ সালে ৭ জন, ২০১৯ সালে ২২ জন, ২০২০ সালে ১৩ জন, ২০২১ সালে ১১ জন ও ২০২২ সালে ৪৭ জন।
এই সাত বছরে ৬০৯টি নৌ দুর্ঘটনায় এসব মানুষ নিখোঁজ ও নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১ হাজার ১০৬ জন।
মৎস্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপ-পরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, ২০২৪ সালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় রেমালের সময়ে সাগরে মাছ ধরায় ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছিল। আমাদের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের কারণে জেলেরা নদী কিংবা সাগরে নামতে না পারায় প্রাণহানি ঘটেনি। ২০২৩ সালের প্রতিবেদনেও নৌ দুর্ঘটনার তথ্য নেই। মূলত সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে মাছ ধরতে গেলে অনেকেই দুর্ঘটনায় পতিত হন।
(এই প্রতিবেদন তৈরিতে বরগুনা জেলা প্রতিনিধি ও ভোলা সংবাদদাতা সহায়তা করেছেন)
আরএআর