‘এক কাপড়ে বাঁইচ্যা আছি, পোলাডা কান্দে ভাতের জন্য’
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন চরগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের কাছে ঘূর্ণিঝড়ের এক সপ্তাহ পরেও সরকারি কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ হাজারের বেশি পরিবারে খাবারের জন্য হাহাকার চলছে। দাতব্য কয়েকটি সংস্থার চিড়া-মুড়ি খেয়ে দিনের পর দিন পার করছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। বাসিন্দারা নদীর দিকে তাকিয়ে থাকেন বড় কোনো নৌযানের অপেক্ষায়। লঞ্চ বা বড় নৌযান চরে ভিড়লে শত শত নারী-পুরুষ জড়ো হচ্ছেন ত্রাণের আশায়। উপজেলার ঢালচর, চরনিজাম, পূর্ব ঢালচর, বয়ার চর ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
চরফ্যাশন উপজেলা সদর থেকে ৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণের কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার নৌপথ পূর্ব ঢালচর। এ ছাড়া চরনিজাম, বয়ারচর মূল ঢালচর থেকে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার নৌপথ। প্রতিটি চরই বুড়া গৌরাঙ্গ, মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত। এজন্য সব সময়ই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হন চরগুলোর বাসিন্দারা।
ঢালচরের বাসিন্দা আব্দুল খালেক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই। যা ছিল সবই রেমাল নিয়া গেছে। এখন পরনের কাপড় ছাড়া আর কোনো সম্পদ নাই। এইভাবে আমাদের ধ্বংস করে দিয়ে গেলেও ঢালচরের মানুষ সরকারের কাছ থেকে এখনো একমুঠো ত্রাণ পায়নি।’
দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে থাকেন রেনু বেগম। স্বামী মিয়ার চরে গেছেন এক আত্মীয়ের কাছ থেকে একসের চাল আনতে। ঢাকা পোস্টকে রেনু বলেন, ‘আমাগো ঘর-বাড়ি-জিনিসপত্তর কিচ্ছু নাই। খালি পোতাডা (ভিটা) পইরা আছে যে। এক কাফরে আইজকা সাতদিন। হ্যাগোর (ছেলেমেয়ের) বাফে গাঙ্গে যাইতে পারে না। চাউল টোকাইতে গ্যাছে আরেক চরে। সরকার আমাগো কিচু দেয় না। মাঝে মাঝে মানসে চিড়া, মুড়ি, চিনি দিয়া যায়। হেইয়্যা খাইয়া আছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বইন্যার দিন পোলাডা ভাইস্যা গ্যাছিল। আমিও লগে। যেরুম হউক হাতরাইয়া-মাতরাইয়া উডলাম। ওইদিনকার থেইকা ভাত খাওয়া বন্ধ। পোলাডা কান্দে ভাতের জন্য। কিন্তু মুই কি হরমু। মোরতো হাতে কোনো কাম নাই।’
জরিনা বেগম নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘মোগো আর কিচু নাই। কোস্টের (কোস্ট ফাউন্ডেশন) বিল্ডিং না থাকলে মোরাও ভাইস্যা যাইতাম। এহন হউর-হাউড়ি (শ্বশুর-শাশুড়ি), পোলা-মাইয়্যা লইয়্যা পাঁচজন আছি শুধু। ঘরে ভাত নাই, পেন্দনের মতো কাফুর (পোশাক) নাই। এক কাফুরেই আছি। সরকার মোগো একমুঠ চাউলও দেয় নাই এহনো।’
ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম পাটওয়ারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢালচর ইউনিয়নটি তছনছ হয়ে গেছে। হাজার খানেক গবাদিপশু ভেসে গেছে। ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। মানুষ খুবই মানবেতন জীবনযাপন করছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার থেকে কোনো ত্রাণসামগ্রী আমাদের চরে এসে পৌঁছেনি।
বর্তমান পরিষদের ইউপি সদস্য মো. মোস্তফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের পর ঢালচরের মানুষ এককথায় না খেয়ে আছে। শত শত পরিবার তাদের সহায়-সম্বল হারিয়েছে। অথচ আমাদের কেউ খোঁজ নিতেও আসে না। কোনো সহায়তাও আসে না। মানুষগুলো খাবারের জন্য হাহাকার করছে।
বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ঢালচরে এখনো কোনো সহায়তা আমরা পাইনি। বিভিন্ন সময়ে চিড়া, মুড়ি, চিনি বা একবেলা খিচুড়ি রেধে নিয়ে আসেন স্বেচ্ছাসেবকরা। সেগুলো অল্প কিছু বাসিন্দার মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। মানুষ খাবার, বাসস্থান ও পানির সংকটে ভুগছে।
যদিও বিষয়গুলো অস্বীকার করেছেন চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নওরীন হক। তিনি বলেন, ঢালচরে সরকারি সহায়তা পৌঁছেছে। যারা বলছেন পাননি তারা ভুল বলছেন। তাছাড়া অনেক চেয়ারম্যানই ওরকম অনেক কথা বলেন, সেইটা বিশ্বাস করার কিছু নেই। তাদের কাছে অলরেডি বরাদ্দ চলে গেছে।
ত্রাণ কখন বিতরণ হয়েছে প্রশ্ন করা হলে ইউএনও বলেন, চেয়ারম্যানের চিঠি দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা চাওয়া হয়েছে। সেটা না দেওয়া পর্যন্ত আমরা ত্রাণ দিতে পারছি না। তারপরও কিছু ত্রাণ অলরেডি পাঠাইছি ঢালচরে।
চেয়ারম্যানকে কেন বলতেছে ত্রাণ পায়নি সেটা এখনই আমি জানতেছি বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নওরীন হক।
প্রসঙ্গত, ঢালচরে বর্তমানে ১০ হাজারের বেশি বাসিন্দা রয়েছে। এর মধ্যে ৪ শতাধিক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদীতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে শতাধিক। দুই হাজারের বেশি গবাদিপশু ভেসে গেছে বলে স্থানীয়রা দাবি করেছেন।
এমজেইউ