আশ্রয়কেন্দ্রে তালা, ১৬ ঘণ্টা টয়লেটের সামনে ছিল এক পরিবার
ঘূর্ণিঝড় রেমাল থেকে বাঁচতে আবাসন থেকে ছুটে গেলেন আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রের রুম খোলা না পেয়ে টয়লেটের সামনে পেতে নিলেন বিছানা। শনিবার (২৫ মে) রাত সাড়ে ৯টা থেকে রোববার (২৬ মে) দুপুর দেড়টা পর্যন্ত টানা ১৬ ঘণ্টা অবস্থান করেন সেখানে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও প্রকাশ করলে ছুটে আসেন প্রধান শিক্ষক, বলেন- ‘আপনারা যে আসবেন আমারে একটা ফোন দিয়ে আসবেন না?’
পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার ৪ নং দেউলি সুবিদখালী ইউনিয়নের পল্লি মঙ্গল মাধ্যমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে এমন ঘটনা ঘটেছে। ২০০৭ সালে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় সিডরের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ও আমেরিকার যৌথ অর্থায়নে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রথম পাকা ভবন নির্মিত হয়।
গত শনিবার রাত ৯টার দিকে আশ্রয়কেন্দ্রটিতে জাহেনুর বেগম (৪৪) তার স্বামী মো. ফারুক সিকদার (৪৯), ছেলো মো. রাব্বি (১৬), মেয়ে মোসা. জান্নাতি আক্তার (১২) ও প্রতিবেশী মানিক জানকে (৬৫) সাথে নিয়ে আশ্রয়ের জন্য আসেন। তারা ২৫ মে থেকে ২৭ মে সকাল পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করেন। তারা পার্শ্ববর্তী সুলতান সিকদার আশ্রয়ণ প্রকল্প ( ২) এ বসবাস করেন।
ভুক্তভোগী জাহেনুর বেগম বলেন, ‘শনিবার রাতে গেছি ৯টার দিকে। তখন বাতাসও ছাড়ছে, বৃষ্টিও নামছে, ভিজ্জাপুইরা হেইপর গেছি। কিন্তু যাইয়া উডমু কই..? কোনো হানে কিছু খোলা পাই নাই। পাইছি ওই স্কুলডাই, স্কুলডা ভাঙ্গাচুরা এহন ধাবারও (দমকা হাওয়া) আয় আর ঘরও লরে দিশাহারা হইয়া বাথরুমের সামনে যাইয়া উঠছি। রাব্বির আব্বায় (স্বামী) যাইয়া আবার কয়েকটা বেঞ্চ আইনা বিছনা কইরা দেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরদিন রোববার দুপুরে কয়েকটা পোলাপাইনে আইয়া ভিডিও করছে। পরে হেডমাস্টারে আইছে, আইয়া কয় আমনেরা এই রকম আইছেন, আমারে একটা ফোন দিয়া আইবেন না..? আমরা কইছি স্যার আমনের নম্বর আছেলে না। হেইপর কয় যে ওপরের রুম খোলা যাইবে না, এইহানে অফিস আর কম্পিউটার আছে। পরে নিচের দুইডা রুম খুলা দেছে আর রুডি কিন্না দিয়া গেছে।’
জাহেনুর বেগমের স্বামী মো. ফারুক সিকদার বলেন, ‘মোরা শনিবার রাইতে স্কুলে গেছি, যাইয়া দেহি দুইডা টিনের রুম খোলা, বাতাসে রুমগুলা লড়ে। আর বিল্ডিংয়ের রুমগুলা সব আটকাইন্না আছেলে। আমরা যাইতে যাইতে ভিজে গেছি। ভেজা কাপড় আর ঠান্ডা বাতাসের কারণে রাব্বির মায়ের গায় জ্বর আইছে। তাই তাড়াতাড়ি তারে লইয়া লেট্রিনের সামনে গেছিলাম।’
তাদের প্রতিবেশী মানিক জান বলেন,‘বইন্নাই দুয়ারের ধারে পানি আইয়া পড়ছেলে। ওই ঘরের ফারুক আর বউ আমারে কইলে লন স্কুলে যাই। ওরা হাদার পরই আমি দুইডা কাঁথা আর একটা বালিশ লইয়া গেলাম। যাইয়া দেহি দুইডা টিনের রুম খুইলা থুইছে। বাতাসের লগে দেহি ঘরডা লড়তে আছেলে। আর ওই ঘরের বউয়ের গায় জ্বর আইছেলে। হেইতে ফারুক লেট্রিনের সামনে বিছনা কইরা দেছে, রাইতে হেইহানেই আছেলাম।’
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাকো সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আদনান হাসান শাওন বলেন, আমরা ২৬ মে দুর্যোগ চলাকালীন এই আশ্রয়কেন্দ্রটি পরিদর্শনের জন্য আসি। এসে দেখি তারা ৫ জন টয়লেটের সামনে বসে আছে। টিনের দুইটা রুম ছাড়া সব রুম তালাবদ্ধ। টিনের রুমগুলোও জরাজীর্ণ ও নড়বড়ে। তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম আপনারা এখানে কখন আসছেন। তখন তারা বললেন. গতকাল রাতে আসছি। হিসেব করে দেখলাম প্রায় ১৬ ঘণ্টা তারা সেখানে অবস্থান করছেন। পরে আমি আমার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভে গিয়ে সকলের সামনে বিষয়টি তুলে ধরি। আমরা চাই যাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে এই দুর্গত মানুষগুলো মানবেতর সময় পার করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালাম বলেন, সাইক্লোন শেল্টারের ওপরে একটা প্রধান শিক্ষকের রুম, একটা কম্পিউটার ল্যাব আর একটা অফিস কক্ষ তাই সেগুলো খোলা হয়নি। কিন্তু পাশের টিনের রুমগুলো খোলা ছিল। আর যারা ভিডিও টা করেছে তারা আমার ও আমার বিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট করার জন্যই এই কাজটি করেছে।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মুহা. মুজিবুর রহমান বলেন, আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে দুর্গত মানুষদের জন্য। তারা এসে টয়লেটের সামনে থাকবে এটা মানা যায় না। আমরা বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখছি। এখানে যদি কেউ দায়িত্বে অবহেলা করে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ঘূর্ণিঝড় রেমাল চলাকালে জেলার ৪ লাখ মানুষের জন্য প্রস্তুত থাকা ৭০৩টি সাইক্লোন শেল্টার ও ৩৫টি মুজিব কেল্লায় ৫১ হাজার দুর্গত মানুষ আশ্রয় নেয়।
আরএআর