মোংলা-বেনাপোল রুটে প্রথম দিনে দুই ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ল ট্রেন
দীর্ঘ অপেক্ষার পর খুলনা-মোংলা রেলপথে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। শনিবার (১ জুন) বিকেল ৩টা ১৫ মিনিটে নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা পর বাগেরহাটের মোংলা রেলস্টেশন থেকে প্রথম যাত্রীবাহী ‘মোংলা কমিউটার’ ট্রেনটি বেনাপোলের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
এর আগে মোংলা রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাগেরহাট-৩ (মোংলা-রামপাল) আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর নাহার। এ সময় মোংলা রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার এইচএম মনির আহমেদসহ রেল কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে এদিন সকাল সোয়া ৯টায় বেনাপোল থেকে ছেড়ে এসে নির্ধারিত সময়ের ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট পর দুপুর ১টায় বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার কাটাখালী রেলস্টেশনে পৌঁছায়। সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে ছেড়ে মোংলা রেলস্টেশনে যায় ট্রেনটি। দুপুর ২টা ১০ মিনিটে মোংলা স্টেশনে পৌঁছায় ট্রেনটি। স্টেশনে ট্রেন পৌঁছালে স্থানীয় লোকজন ও যাত্রীদের মাঝে ব্যাপক উৎসহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। প্রথম দিন হওয়ায় ট্রেন পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো উদ্বেগ ছিল না সাধারণ মানুষের মধ্যে।
ট্রেন ভ্রমণে আসা সাত বছর বায়সী তাসনিয়া বলে, বইতে পড়েছি ট্রেনের কবিতা। মোবাইলে আর টিভিতে দেখেছি, কখনো উঠতে পারি নাই ট্রেনে। এই প্রথম ট্রেনে উঠতে এসেছি। আমার খুব ভালো লাগছে।
খুলনার ফুলতলা থেকে মোংলা স্টেশনে আসা যাত্রী শিউলি বাসার বলেন, মোংলা স্টেশনে এসে ট্রেনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে ইতিহাসের সাক্ষী হলাম। বেনাপোল থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনে ফুলতলা স্টেশন থেকে উঠে মোংলায় এসেছিলাম আবার মোংলা থেকে বেনাপোলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মোংলা রুটের প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেনে ওঠার এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
যশোর রেলস্টেশন থেকে মোংলার উদ্দেশ্যে আসা যাত্রী মেহেদী হাসান বলেন, ঝিনাইদহ থেকে সকালে যশোর এসেছি শুধুমাত্র নতুন চালু হওয়া এই ট্রেনে করে মোংলায় আসার জন্য। এই ট্রেন চালু হওয়ার মাধ্যমে মোংলা থেকে সুন্দরবন ভ্রমণ সহজ হয়ে গেল। আগেও যশোর থেকে মোংলায় এসেছি তবে বাসে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হত। এবার ট্রেনে এসে সহজে আবার যশোরের দিকে ফিরতে পারছি।
খুলনার ফুলতলার যাত্রী ৬৯ বছর বয়সী সুনীল কুমার মিত্র বলেন, খুলনা থেকে মোংলায় ট্রেন চালু হওয়ার মাধ্যমে এ অঞ্চলের উন্নয়ন-অগ্রগতির দুয়ার খুলল। অনেক মানুষ মোংলায় চাকরি করেন। তারা এই ট্রেনের মাধ্যমে খুলনা থেকে যাতায়াত করে সুফল ভোগ করবেন। এছাড়া ব্যবসায়ীরা খুব সহজে বন্দর থেকে মালামাল পরিবহন করতে পারবেন।
এদিকে মোংলা বন্দর প্রতিষ্ঠার ৭৩ বছর পর রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়াকে নতুন দিগন্ত হিসেবে দেখছেন এখানকার ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধরা।
বাগেরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুন নাহার বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের জন্য এই রেললাইন উপহার হিসেবে দিয়েছেন। আজ মোংলা থেকে বেনাপোল রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হলো। এটার সুফল শুধু আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষ ভোগ করবে না। এ ট্রেন চালুর মধ্যে দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ হলো। এতে এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। এর মাধ্যমে আমাদের এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হলো।
মোংলা রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার এসএম মনির আহমেদ বলেন, মোংলা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে।
মোংলা থেকে ৩৬১ জন যাত্রী নিয়ে বিকেল ৩টার দিকে ট্রেনটি বেনাপোলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। আপাতত প্রতিদিন একটি ট্রেন বেনাপোল থেকে মোংলায় আসবে এবং মোংলা থেকে একটি ট্রেন বেনাপোলের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে।
বিলম্ব হওয়ার কারণ সম্পর্কে স্টেশন মাস্টার বলেন, খুলনায় আমাদের অন্য একটি ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়েছিল। যার কারণে লাইন বন্ধ রাখতে হয়েছে। এজন্য কিছুটা দেরিতে পৌঁছেছে ট্রেনটি।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১০ সালে। জমি অধিগ্রহণ, রেললাইন, রেলসেতু নির্মাণসহ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৭২১ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ২০২১ সালে আবারও সময় ও ব্যয় দুটিই বাড়ানো হয়। তখন দাঁড়ায় চার হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। সেই মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ধরা হয়। রূপসা নদীর ওপর ৫.১৩ কিলোমিটার সেতু, ফুলতলা থেকে মোংলা পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার পথ হলেও স্টেশনগুলোর ডাবল লাইন হিসাব করে ৯১ কিলোমিটার পথ, ৯টি প্ল্যাটফর্ম এবং ১০৭টি ছোট সেতু এবং ৯টি আন্ডারপাস নির্মাণ শেষ হয়েছে। সেই সঙ্গে সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন কাজও শেষ হয়েছে।
এই ট্রেন চলাচলের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠার ৭৩ বছর পর রেল যোগাযোগে যুক্ত হলো মোংলা সমুদ্রবন্দর। ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভার্চুয়ালি এই রেলপথের উদ্বোধন করেন। এর আগে ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর ফুলতলা থেকে মোংলা পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চালানো হয়। স্থায়ী জনবল নিয়োগসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও প্রস্তুতি সম্পন্ন করে যাত্রী নিয়ে ট্রেন চালু করা হচ্ছে।
শেখ আবু তালেব/আরএআর