বিচ্ছিন্ন ঘটনায় উত্তপ্ত ভোটের মাঠ, সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কা
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে আগামীকাল ২১ মে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। প্রতীক পাওয়ার পর থেকে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় প্রার্থীরা ব্যস্ত থাকলেও ভোটারদের মধ্যে তেমন আগ্রহ-উদ্দীপনা নেই।
শিবালয় উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে তিনজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হলেন- উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউর রহমান খান জানু, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রহিম খান এবং ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন খান পান্নু। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ) পদে সাতজন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে চারজন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে রেজাউর রহমান খান ও আবদুর রহিম খানের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। উপজেলা নির্বাচনে দুইজনই চেয়ারম্যানপ্রার্থী হওয়ায় এই দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে নির্বাচনের ভোটের মাঠ এবং সাধারণ ভোটারদের মধ্যে। দুই প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকের মধ্যে সম্প্রতি হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ, গুলি, মহাসড়ক অবরোধ, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও মামলার ঘটনায় ভোটের মাঠ বেশ উত্তপ্ত। ফলে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট হওয়া নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন ভোটাররা। তবে নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে ভোট করতে বদ্ধপরিকর নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে শিবালয় উপজেলার আরিচা, টেপড়া, মহাদেপুর, উথুলীসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনের শঙ্কার কথা জানা গেছে। টেপড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় উপজেলা পরিষদের গেটের সামনের কাঁঠালতলায় চায়ের দোকানগুলোতে নির্বাচনের তেমন আমেজ নেই। প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরা নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করলেও তাতে তেমন কান দিচ্ছেন না উপস্থিত ভোটাররা। বলা যায় একই চিত্র পুরো উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারসহ জনসমাগমস্থলে।
জানা গেছে, সম্প্রতি আরিচা ঘাট যাওয়ার আগে ডাক্তারখানা এলাকায় পোস্টার সাঁটানোকে কেন্দ্র করে দুই চেয়ারম্যানপ্রার্থী রেজাউর রহমান খান জানু ও আবদুর রহিম খানের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মারামারি হয়। এই ঘটনায় রেজাউর রহমান খানের ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক ফাহিম খান রনি ডাক্তারখানা এলাকায় গিয়ে ফিল্মি স্টাইলে ফাঁকা গুলি ছুড়েন। এর প্রতিবাদে আবদুর রহিম খানের কর্মীরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেন। এর আগে গত ৭ এপ্রিল আবদুর রহিম খানের কর্মীর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত ২৭ এপ্রিল নির্বাচনী প্রচারণা শেষে ফেরার পথে আবদুর রহিম খানের গাড়ি লক্ষ্য করে ককটেল বিস্ফোরণ করা হয়। এ ছাড়া পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, হামলা ও মামলার ঘটনা ঘটে। দুই চেয়ারম্যানপ্রার্থীর মধ্যকার এমন দ্বন্দ্বের কারণে এলাকার সাধারণ ভোটাররা নির্বাচন সুষ্ঠু নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। আর ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার বিষয়েও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
উপজেলা পরিষদের ফটকের সামনে নির্বাচন নিয়ে কথা হয় উপজেলার উথুলী ইউনিয়নের নিহন্দ গ্রামের অটোরিকশাচালক লোকমান হোসেনের সঙ্গে। আলাপকালে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দুই প্রার্থীই অনেক শক্তিশালী, কেউ কারও চেয়ে কম না। এখন ভোটের দিন কেন্দ্রে যাইতে পারুম কি না এইডাও কইতে পারি না। দেখা গেল কেন্দ্রে গেলাম মারামারি হইলো, গুলাগুলি হইলো। আমি রিকশাচালক, দিনমজুরি কইরা খাই। ভোটকেন্দ্রে গেছি হয়ত গুলি করলো বা মারামারি লাগলো। এসব ভয়ে হয়ত ভোটকেন্দ্রে নাও যাইতে পারি।’
উপজেলার আরিচা এলাকার ভোটার ও সুশীল সমাজের ব্যক্তি মো. শাহজাহান বিশ্বাস বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখানে বর্তমান ও সাবেক দুই চেয়ারম্যানের মধ্যে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চলছে এবং একে অন্যের প্রতি মরিয়া হয়ে লেগেছে। এই দুইজনই ভোটের মাঠ গরম করে রেখেছেন। কিছুদিন আগে পোস্টার সাঁটানোকে কেন্দ্র করে গুলির ঘটনাও ঘটেছে। এই কারণে ভোটারদের মধ্যে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে অনেকটা শঙ্কায় আছি। সাধারণ ভোটার এবং নাগরিক হিসেবে এই ধরনের পরিস্থিতি আমরা প্রত্যাশা করি না।
একই এলাকার মো. রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিবালয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে আমরা সাধারণ ভোটার ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ খুবই শঙ্কিত ও আতঙ্কিত। উভয়পক্ষ যেভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে এটা সুষ্ঠু ভোটের অন্তরায়। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের পক্ষে সুষ্ঠু ও সুন্দর ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করতে ভোটারদের যদি শান্ত করা না যায় তাহলে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি খুবই কম হবে বলে মনে করি।
ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নিজেই সন্দিহান রয়েছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুর রহিম খান। জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে, তাই বলে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখাবে কেন? নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ব্যতীত কারও কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকার কথা না। তাহলে কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রেজাউরের ছেলের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে এবং সে জনসমাগমে প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ে। এসব বিষয়ে অভিযোগ দিলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাদের এমন কর্মকাণ্ডে সাধারণ ভোটাররা আতঙ্কিত, তাহলে ভোটার উপস্থিতি কীভাবে বাড়বে বরং কম হবে।
এসব জানতে চাইলে চেয়ারম্যানপ্রার্থী রেজাউর রহমান খান বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমার পরিবারে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বাংলাদেশ যেমন নিরাপদ, তেমনি আমার কাছে এই শিবালয় উপজেলা নিরাপদ বলে বিশ্বাস করি। তারা (প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী) ভোটের মাঠ উত্তপ্ত করে তুলছে। আমার কর্মীদের ভয় দেখাচ্ছে। ভোটের মাঠে আমার পরিস্থিতি ভালো দেখে তাদের মাথা গরম হয়ে গেছে। আমার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ নেই, নেই কোনো ভূমিদস্যুতার অভিযোগ। কিন্তু আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ রয়েছে। আশা করছি ২১ মে শিবালয়ে একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট অনুষ্ঠিত হবে।
এ বিষয়ে শিবালয় থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবদুর রউফ সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ সুপারের নির্দেশনা অনুযায়ী সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট অনুষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
দুই পক্ষের মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, উভয়পক্ষের অভিযোগে মামলা হয়েছে এবং মামলা তদন্তাধীন। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
এসব বিষয়ে শিবালয় উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং রিটার্নিং কর্মকতা মো. বেলাল হোসেন বলেন, উপজেলা নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আয়োজনের লক্ষ্যে আমাদের সকল ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে সেগুলো নিয়ে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। কেউ যদি নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করে, সে যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে নয়। রাষ্ট্র এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে আমাদের দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।
এমজেইউ