কোথায় ফরিদপুরের সেই ইউপি চেয়ারম্যান?
ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লি গ্রামে মন্দিরে প্রতিমার শাড়িতে আগুন দেওয়া নিয়ে সহোদর দুই শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার ২৫ দিন পেরিয়েছে। শ্রমিকদের বেঁধে মারধরে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার পরও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও মধুখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য শাহ আসাদুজ্জামানকে। এখনো অধরাই রয়ে গেছেন ইউপি চেয়ারম্যান। সর্বশেষ ২১ এপ্রিল তাকে বাড়িতে দেখেছে এলাকাবাসী।
পুলিশের ধারণা- দেশের কোথাও ঘাপটি মেরে আছেন তিনি। সঙ্গে কোনো ডিজিটাল যন্ত্র না থাকায় তাকে গ্রেপ্তারে বেগ পেতে হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শাহ আসাদুজ্জামান ডুমাইন ইউনিয়নের ডুমাইন গ্রামের বাসিন্দা। ২০১২ সালে ইউপি নির্বাচনে তিনি প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে ইউপি নির্বাচনে তাকে পরাজিত করে খোরশেদ আলম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে শাহ আসাদুজ্জামান উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২২ সালের ইউপি নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী খোরশেদ আলমকে পরাজিত করে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে পুনরায় ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০২৩ সালে মধুখালীর ইউএনওর ওপর হামলা ও টিসিবির কার্ড আত্মসাৎ করার ঘটনায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে দুই বার বরখাস্ত হন ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান। তবে দুই বারই তিনি উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে তার পদ ফিরে পান।
এ বিষয়ে সম্প্রতি নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেছিলেন, দুই বার বরখাস্ত হওয়ার পর পদ ফিরে পাওয়ায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান। তিনি ‘অভ্যাসগত অপরাধী।’ আমরা প্রশাসনিকভাবে তার এ কর্মকাণ্ড ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত স্থগিত করে রায় আনায় তার মধ্যে একটা বেপরোয়া ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাকে কেউ কিছু করতে পারবে না, এ রকম একটি ভাব তার মধ্যে চলে আসার কারণে তিনি অনেকটা বেপরোয়া হয়ে গেছেন। বেআইনি কাজ করে যাচ্ছিলেন।
জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান বলেছিলেন, ইউএনওর ওপর হামলা, পুলিশের ওপর হামলা ও টিন চুরির ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়। ওই মামলাগুলোর তদন্ত কাজ শেষ করে গত এক বছরেও কোনটিরই অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়নি পুলিশ।
বার বার শাহ আসাদুজ্জামানের দ্বারা বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হওয়া ও মামলা হওয়ার পরও উপজেলা আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেয়নি। কোনো কোনো দায়িত্বশীল আওয়ামী লীগ নেতার তার প্রতি আশীর্বাদ রয়েছে। তাই বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম করেও বার বার পার পেয়ে যাচ্ছেন এই ইউপি চেয়ারম্যান- এমনটাই মনে করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ এলাকাবাসী।
স্থানীয় দুই আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার পর ভিডিওতে তার অংশগ্রহণ দেখা গেলে ২১ এপ্রিল গা ঢাকা দেন ইউপি চেয়ারম্যান। টিসিবির কার্ড আত্মসাৎ, ইউএনওর ওপর হামলা, আবার এই নতুন বিতর্কে জড়ানো- এসবে বার বার কেন উনিই জড়ান এটা আমাদের বুঝে আসে না। ওইদিন সন্ধ্যায় পঞ্চপল্লিতে যখন উনি গেলেন, তখনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। খুব সহজেই উনি শ্রমিকদেরকে ওখান থেকে উদ্ধার করে ইউপি ভবন বা থানায় নিয়ে যেতে পারতেন। এমন করলে উনি নিজে প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি দুইটা প্রাণ বেঁচে যেত। চেয়ারম্যান ‘হিরোইজম’ দেখাতে গিয়ে প্রথমে ওদের মারধর করল এবং তা দেখে এলাকাবাসী উদ্বুদ্ধ হয়ে এত বড় একটা ঘটনার জন্ম দিল। চেয়ারম্যানের একটু কৌশলেই এই অঘটন এড়ানো সম্ভব ছিল।
গত ১৮ এপ্রিল রাতে পঞ্চপল্লি মন্দিরে প্রতিমার শাড়িতে আগুন দেওয়া এবং সন্দেহের বশে পাশের পঞ্চপল্লি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওয়াশ ব্লক প্রকল্পের আওতায় টয়লেট নির্মাণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে আটকে রেখে মারধর করা হয়। পরবর্তীতে আশরাফুল ও আসাদুল নামে দুই সহোদর শ্রমিক মারা যান।
নির্মাণ শ্রমিকদের পিটুনি দিচ্ছেন ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য শাহ আসাদুজ্জামান- এ সংক্রান্ত দুটি ভিডিও ফুটেজ গত ২১ এপ্রিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের কক্ষে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা শ্রমিকদেরকে ইউপি চেয়ারম্যান জেরা করছেন। এ সংক্রান্ত আরেকটি ভিডিও ভাইরাল হয় ২৩ এপ্রিল। ওই ভিডিওতে সাদা টি-শার্ট পরিহিত চেয়ারম্যানকে লাঠি দিয়ে শ্রমিকদের মারতেও দেখা যায়।
তবে ২১ এপ্রিলের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই মুঠোফোনসহ সকল ডিজিটাল যন্ত্র বাড়িতে রেখে পালিয়ে যান শাহ আসাদুজ্জামান। মাঝে মাগুরা ও যশোরে তাকে গ্রেপ্তারের খুব কাছাকাছি গিয়েও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তবে ১৮ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত কাজ ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন তথ্য দিতেন ইউপি চেয়ারম্যান।
ইউপি চেয়ারম্যান ঘটনার রাতে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, তিনি ঘটনা ঘটার পর ইউপি সদস্য অজিত বিশ্বাসের কল পেয়ে ঘটনাস্থলে যান। ঘটনাস্থলে এসে শত শত মানুষ জড়ো হওয়া দেখে পুলিশে খবর দেন। পাশাপাশি উত্তেজিত জনতাদের নিবৃত করতে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেও অনেক মানুষ জড়ো হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। ভিডিও ভাইরালের আগে এই বক্তব্যই তিনি সবখানে দিয়েছেন।
তবে ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তার প্রতারণা সামনে চলে আসে। প্রমাণ হয় তিনিই আগে শ্রমিকদের মারধর শুরু করেছেন। পরে যোগ দিয়েছেন উত্তেজিত এলাকাবাসী। এরপর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নেওয়ার আগেই পালিয়ে যান তিনি। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালকদার ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য অজিত বিশ্বাসকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তথ্য প্রদান করা হলে তার নাম গোপন রেখে তাকে পুরস্কৃত করা হবে বলেও ঘোষণা দেন।
পঞ্চপল্লির ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয় মধুখালী থানায়। দুই ছেলেকে হত্যার ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন মো. শাহজাহান খান। মন্দিরের প্রতিমায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন ওই মন্দিরের পূজারি অপতী মন্ডল। এছাড়া পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে মামরা করেন মধুখালী থানার উপ-পরিদর্শক শংকর বালা। তিনটি মামলায় শুধু পুলিশের মামলায় আসামি হিসেবে ৩১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে আসামি হিসেবে ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামানের নাম নেই।
মধুখালী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিরাজ হোসেন বলেন, শুধু পুলিশ নয়, সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরই ওই চেয়ারম্যানকে ধরতে তৎপর রয়েছে। তবে তার সঙ্গে কোনো ডিজিটাল যন্ত্র না থাকায় তাকে ট্রেস করতে বেগ পেতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাকে গ্রেপ্তারে কয়েকবার অভিযান চালানো হয়েছে। তবে সেসব অভিযান সফল হয়নি। তাকে ধরতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
জহির হোসেন/আরএআর