মা মা বলে কেঁদেই যাচ্ছে শিশুটি
সড়ক দুর্ঘটনায় মা জায়েদা মারা গেলেও বেঁচে আছে দেড় বছরের শিশুপুত্র মেহেদি হাসান জায়েদ। শিশুটির একমাত্র অবলম্বন মা সারা জীবনের জন্য তাকে ছেড়ে চলে গেছে- সেটি বুঝার ক্ষমতা নেই তার। ক্ষণে ক্ষণে আধো আধো বুলিতে মা মা বলে কেঁদেই যাচ্ছে শিশুটি। পাশে থাকা চিকিৎসক-নার্স কেউই শিশুটির কান্না থামাতে পারছেন না।
এমন চিত্র ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে। শনিবার (১১ মে) রাতে নিহত নারী ও তার শিশুপুত্রের পরিচয় মিললে রোববার (১২ মে) হাসপাতালে ছুটে আসেন নিহত ওই নারীর ভাই ও শিশুটির মামা রবিন মিয়া। ময়নাতদন্ত শেষে জায়েদার মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে হাসপাতালে এখনো শিশুটির চিকিৎসা চলছে।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার (৯ মে) দিবাগত রাত ৩টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভালুকার স্কয়ার মাস্টারবাড়ি এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন জায়েদা (৩২) ও তার শিশুপুত্র জায়েদ। ভোররাতে কে বা কারা তাদের আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। এরপর সেখান থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাতে জায়েদার মৃত্যু হয়। হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে শিশু জায়েদ। ঘটনার পর থেকে তাদের পরিচয় মিলছিল না। স্বজনের খোঁজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিশুটির ছবি পোস্ট করেন অনেকে।
সেই ছবিতে দেখা যায়, স্ট্রেচারে নারীর নিথর দেহ। মাথায় ব্যান্ডেজ। তার বুকের ওপর শুয়ে কাঁদছে ছোট্ট শিশু। তার মাথায়ও ব্যান্ডেজ। পাশে থাকা চিকিৎসক-নার্স কেউই শিশুটির কান্না থামাতে পারছেন না। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের এই দৃশ্য দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি কেউ। শিশুটির কান্নার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে শনিবার রাতে স্বজনের খোঁজ মেলে।
আরও পড়ুন
জায়েদা সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার কুশিউড়া গ্রামের রমিজ উদ্দিনের মেয়ে। ছেলে জায়েদকে নিয়ে তিনি ময়মনসিংহের ভালুকার স্কয়ার মাস্টারবাড়ি এলাকায় থাকতেন।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য তারিকুল ইসলাম আহত শিশু জাহিদ ও তার মাকে ময়মনসিংহ মেডিকেলে ভর্তি করেছিলেন। তারিকুল বলেন, শিশুটিকে হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে এবং তার মাকে ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে জায়েদা মারা যান। মরদেহ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।
২৬ নম্বর ওয়ার্ডের এক রোগীর স্বজন বেদেনা আক্তার জানান, ওই নারী যখন অজ্ঞান অবস্থায় ছিলো তখনও শিশুটি তাদের মায়ের বুকের দুধ পান করেছে। এই দৃশ্য দেখে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।
ময়নাতদন্ত শেষে মায়ের মরদেহ হস্তান্তর, জায়েদের চিকিৎসা চলছে
জায়েদার মৃত্যুর ঘটনায় ভরাডোবা হাইওয়ে থানা পুলিশের পক্ষ থেকে অজ্ঞাত গাড়ির বিরুদ্ধে রোববার কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। পুলিশ জায়েদার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে ভাই রবিন মিয়ার কাছে হন্তান্তর করেছে বলে নিশ্চিত করেন কোতোয়ালি থানার এসআই আবুল কাশেম। তবে মরদেহ হন্তান্তর করলেও শিশু জায়েদকে হস্তান্তর করা হয়নি।
রোববার বোনের লাশ ও ভাগনেকে নিতে আসেন রবিন মিয়া। তিনি জায়েদার বড় ভাই দাবি করেন। রবিন জানান, জায়েদার একাধিক বিয়ে হয়েছে। ভালুকা এলাকায় থেকে কখনো গার্মেন্টসসে, কখনও জুতার কারখানায় কাজ করে জীবন চালাতো। বোনের মরদেহ দিলেও ভাগনেকে না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
ভালুকার ভরাডোবা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আতাউর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় ওই নারীর মৃত্যু ও শিশুটি আহত হয়েছে প্রাথমিক তদন্ত ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মাধ্যমে এমনটিই জানা গেছে। বিষয়টি নিয়ে থানায় সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করা হয়েছে। ওই নারী প্রায়ই গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতেন।
এদিকে শিশুটির মামা দাবি করা রবিন শিশুটিকে নিতে চাইলে রোববার দুপুরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সমাজসেবা বিভাগ শিশুটির বিষয়ে বৈঠক করে। শিশুটির প্রকৃত অভিভাবক নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত হস্তান্তর না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সমাজসেবা অধিপ্তরের ময়মনসিংহের উপপরিচালক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, বিষয়টি যেহেতু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে অনেকে পরিচয় দিয়ে শিশুটিকে নিতে আসতে পারে। আমরা উপযুক্ত কাগজপত্র ছাড়া হস্তান্তর করলে বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ হয়। পর্যাপ্ত কাগজপত্র নিয়ে আসলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে হস্তান্তর করবে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. জাকিউল ইসলাম বলেন, শিশুটি যেন ভালোভাবে মানুষ হতে পারে সেদিক চিন্তা করে প্রশাসন ও সমাজসেবার সঙ্গে আলাপ করে হস্তান্তরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ভালুকা মডেল থানার ওসি শাহ কামাল আকন্দ বলেন, প্রাথমিকভাবে ঘটনাটি সড়ক দুর্ঘটনা মনে হলেও মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে, কোনো একটি প্রাইভেটকার চাপা দিয়ে আহত করেছে।
কোতোয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আনোয়ার হোসেন বলেন, নারীর প্রকৃত স্বজন নিয়ে কোনো সন্দেহ তৈরি না হওয়ায় মরদেহ তার (রবিন) কাছে হস্তান্তর করা হয়।
উবায়দুল হক/আরএআর