লালমাই পাহাড় কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে প্রভাবশালীরা
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অন্যতম কুমিল্লার লালমাই পাহাড় কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে দস্যুরা। অবাধে মাটি কাটার ফলে একে একে বিলুপ্ত হওয়ার পথে পাহাড়ের টিলাগুলো। সচেতন মহলের ধারণা এভাবে অবাধে মাটি কাটতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বিলুপ্ত হবে ঐতিহ্যবাহী এই পাহাড়টি।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ইন্ধন এবং ছত্রছায়ায় এসব মাটি কাটছে কয়েকটি চক্র। পাহাড়ের সবচেয়ে বেশি মাটি কাটা হয় সালমানপুর, ষাট কলোনি, রাজারখলা, বড় ধর্মপুর, ইটাখোলা মুড়া, জামমুড়া, রতনপুর কোটবাড়ি, সানন্দা, রাঙ্গামুড়া, বড়বাতুয়া, ভাঙ্গামুড়া, চৌধুরীখোলা, ধনমুড়া, হাতিগাড়া, রাণী ময়নামতি প্রাসাদের পাশের এলাকায়।
বিজয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম খোকা, রাসেল ওরফে ভাগিনা রাসেল, সাবেক ইউপি সদস্য জামাল ওরফে জামাল মেম্বার, চন্ডি মণ্ডলসহ বেশ কয়েকটি সক্রিয় চক্র জড়িত বলে জানা গেছে। এসব চক্র স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই পাহাড়ের মাটি কেটে সাবাড় করছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পাহাড়ের বুক থেকে কাটা এসব মাটি আদর্শ সদর, সদর দক্ষিণ, বুড়িচং এবং বরুড়া উপজেলার কয়েকটি ইটভাটায় বিক্রি করা হয়ে থাকে। এর সত্যতা জানতে অভিযুক্তদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এসব দস্যুদের ভয়ে পাহাড়ের বসবাসকারী মানুষেরা ভীতসন্ত্রস্ত থাকে সবসময়। ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না। মাটি কাটার তথ্য দিলে পড়তে হয় বিপদে শুধু এই ভয়ে থাকা মানুষদের চোখের সামনেই অবাধে মাটি কেটে নেয় দস্যুরা।
তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করা হলেও তা একেবারেই দায়সারা বলে জানান স্থানীয়রা। এসব নাম স্বর্বস্ব অভিযানে মাটি কাটার শ্রমিকদের মাঝেমধ্যে জেল-জরিমানা করা হলেও সিন্ডিকেটের মূলহোতারা থাকেন অধরা। ফলে প্রশাসনেও আস্থা হারিয়েছেন পাহাড়ের বাসিন্দারা।
নাম গোপন রাখার শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, চোখের সামনে পাহাড়ের টিলাগুলো কেটে ফেলছে, তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার থাকে না। প্রতিবাদ তো দূরের কথা এসব বিষয়ে মাথা ঘামালেই বিপদ।
আরও এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দিনের বেলায় পাহাড়ের মাটি কমই কাটা হয়। বেশিরভাগ মাটি কাটা হয় রাতের আঁধারে। কাটা এসব মাটি পাচার হয় বিভিন্ন ইটভাটায়। দস্যুদের সিন্ডিকেট অনেক বড়। প্রশাসন তো আর রাতের বেলায় আসে না।
লালমাই পাহাড়টি জেলার বেশিরভাগ অংশই সদর দক্ষিণ উপজেলার বিভিন্ন অংশ বেষ্টিত। এ ছাড়াও পাহাড়ের অংশ রয়েছে আদর্শ সদর, বরুড়া ও বুড়িচং উপজেলায়ও। পাহাড়টির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪ কিলোমিটার, প্রস্থ প্রায় ৩ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ উচ্চতা প্রায় ৫০ মিটার। এতে বাস করে বিভিন্ন সরীসৃপ, উভচর, স্তন্যপায়ী এবং মেরুদণ্ডীসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণি। পাহাড়টি কাটার ফলে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে এসব বন্যপ্রাণি।
অপরদিকে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সম্প্রসারণের নামে সালমানপুর, রাজারখলা এলাকার পাহাড় কেটে সাবাড় করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সম্প্রসারিত প্রকল্পের আওতায় ১৯৩.১৯ একর অধিগ্রহণকৃত জমি আছে। এর মধ্যে ১৩১ একর জমি পাহাড় ও টিলাশ্রেণির। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনার জন্য লালমাই মৌজার রাজারখলা এলাকায় টিলা কেটে স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। যা পাহাড়ের জন্য বড় ধরনের হুমকিস্বরূপ বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের। টিলাগুলো কাটার ফলে সৌন্দর্য হারাতে বসেছে পাহাড়টি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কোটবাড়ি জাদুঘর থেকে পশ্চিমের সড়কে কাশবন নামের দুটি পার্ক ও রিসোর্ট, ব্লুওয়াটার পার্ক, বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণে ডাইনোসর ও ম্যাজিক প্যারাডাইসসহ কয়েকটি বিনোদন পার্ক নির্মাণে কমবেশি পাহাড় ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। বেসরকারি সিসিএন বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা ফিজিক্যাল কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানার বিভিন্ন স্থাপনা তৈরিতে পাহাড় কাটা হয়েছে। আবার পাহাড়ের বুকে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে মালিকানা দাবি করা হয়েছে বিভিন্ন অংশে। ঝুলিয়ে রাখা সেসব সাইনবোর্ডে হাইকোর্টের আদেশে মালিকানা নির্দেশ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হলেও সেসব নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে জনমনে।
নানান অজুহাতে পাহাড়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ কাটার ফলে পাহাড়ের সৌন্দর্যের পাশাপাশি পাহাড়কে শোভিত করা বিভিন্ন পশুপাখি, পোকামাকড় ও জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি ঘটতে পারে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
পরিবেশ আন্দোলন কুমিল্লার সভাপতি ড. মোসলেহ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, লালমাই পাহাড় আমাদের জন্য গৌরবের। এটিকে রক্ষা করতে হবে। কোনো অজুহাতেই পাহাড় কাটা শোভা পায় না। মাটি কাটার সিন্ডিকেটরা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। প্রশাসনকে অবশ্যই জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ-পরিচালক মোসাব্বের হোসেন মোহাম্মদ রাজীব ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারাই পাহাড় কাটছে আমাদের কাছে তথ্য আসার সাথে সাথেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্প্রসারণের নামে অনুমতি ছাড়াই পাহাড় কাটছে। কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয়ে অনুমতির আবেদন করেছিল। কিন্তু এখনও অনুমোদন পায়নি। এ ফাইলটি এখনও মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। কিন্তু তার আগেই তারা পাহাড় কাটতে শুরু করেছে।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মুশফিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে।
আরিফ আজগর/এমএএস