২০ বছর ধরে চরখানপুরে নেই কোনো হাসপাতাল-উচ্চবিদ্যালয়
রাজশাহীর একটি দুর্গম অঞ্চল চর খানপুর। ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা চরটিতে বসবাস করেন প্রায় দুই হাজার মানুষ। এদেরও বিভিন্ন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয় এ চরে। প্রতিবছরই নদী ভাঙনের কবলে অনেককেই হারাতে হয় বসতভিটা। ২০০৪ সালে চরটিতে একটি ক্লিনিক থাকলেও সেটি নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। এরপর চরখানপুরে আর কোনো হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক তৈরি হয়নি। ফলে চিকিৎসা সেবার নাজুক অবস্থার মধ্যে বসবাস করছেন চরবাসী।
রাজশাহী শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরের এ চরের মানুষ গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তবে দুইজন গ্রাম্য চিকিৎসকের সেবায় জ্বর, সর্দি-কাশি সারলেও অন্য অসুখের চিকিৎসা নিতে গ্রামবাসীকে যেতে হয় রাজশাহী শহরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকে।
জানা গেছে, চরখানপুরে বসতঘর আছে ৮৫০টির মতো। গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও নেই উচ্চ বিদ্যালয়। তবে চারটি মসজিদ ও একটি মাদ্রাসা রয়েছে। গ্রামে দীর্ঘ ১৫ থেকে ১৭ বছরের বেশি সময় ছিল না হাট। তবে গত ১৯ এপ্রিল থেকে গ্রামের স্কুল মাঠে বসছে হাট। প্রায় সাড়ে আট শতাধিক পরিবার অধ্যুষিত গ্রামে কোনো রাস্তাঘাট নেই। গ্রামটিতে যাতায়াতের একমাত্র বাহন নৌকা।
চরখানপুর থেকে রাজশাহী শহরে যেতে এক ঘণ্টার মতো সময় লাগে। গ্রামের প্রতিটি ঘরে সৌরবিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা রয়েছে। পদ্মা নদীকে উপজীব্য করে জীবিকা নির্বাহ করেন গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ। তবে পদ্মা নদীই তাদের বড় দুঃখ। নদীভাঙনের ফলে বারবার বিলীন হয়ে যাচ্ছে তাদের আবাসস্থল, সহায়সম্পদ। তাই কিছুদিন পরপরই তাদের পরিবর্তন করতে হচ্ছে বাসস্থান। একসময় এ গ্রামে তিন হাজারের বেশি পরিবার থাকলেও এখন কমে গেছে জনবসতি। যদিও বর্তমানে কৃষি ও পশু পালন তাদের জীবিকার মূল উৎস। চরের জমিতে ধান চাষ ও পশু পালন ছাড়াও নদীতে মাছ শিকার ও নৌকা চালিয়ে চলে তাদের সংসার।
এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা সাবান আলী বলেন, চরখানপুর গ্রামটি চরখিদিরপুর মৌজায় অবস্থিত। কিন্তু নদী গর্ভে বিলীন হওয়ায় খিদিরপুর এলাকার এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। এ গ্রামের মানুষের জীবন জীবিকার মূল উৎস কৃষি কাজ ও পশু পালন। অনেকেই মাছ শিকার করেন।
তিনি আরও বলেন, গ্রামে স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা একেবারে নাজুক। এখানে দু’জন গ্রাম্য চিকিৎসক আছেন। যারা জ্বর, কাশির চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে রাজশাহী শহরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। আর সন্তান সম্ভাব্য নারীদের আগে থেকেই শহরে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। অনেকের রাজশাহী শহরের আশেপাশে আত্মীয়ের বাড়ি রয়েছে। যাদের নেই তারা প্রসববেদনা উঠলে দ্রুত ঠেলাগাড়ি দিয়ে নদীর ঘাট, ঘাট থেকে নৌকায় নদী পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান।
এই এলাকায় নানা বাড়ি আকাশ আলীর। তিনি পাঁচ বছর পরে বেড়াতে এসেছেন চরখানপুরে। তিনি বলেন, এই চরের ছেলে-মেয়েরা শহরের স্কুলে-কলেজে পড়ালেখা করে। সেই জায়গা থেকে শিক্ষায় নারীরা অনেক পিছিয়ে। এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। তাই মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাগ্রহণে চরের ছেলে-মেয়েদের যেতে হয় রাজশাহী শহরে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্রামের ৪৫ বছরের এক নারী বলেন, আগে তো মানুষের অসুখ কম ছিল। এখন মানুষের শরীরে নানা অসুখ বাসা বেধেছে। এখানে সকারিভাবে কোনো চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা নেই। অনেকেই সন্তান প্রসব করে বাসাবাড়িতে। বেশি অসুস্থ হলে রাজশাহী শহরের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। এখানে সরকারিভাবে সপ্তাহে দু’দিন হলেও চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা দরকার।
গ্রামের গ্রাম্য চিকিৎসক পারভেজ সাজ্জাদ জানান, তিনি গ্রামে ঘুরে ঘুরে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। তিনি শহর থেকে ওষুধ কিনে নিয়ে আসেন। এরপরে তা চর খানপুরে বিক্রি করেন। তার দাবি, গ্রামে রাস্তাঘাট না থাকায় বর্ষাকালে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হয়।
এ বিষয়ে পবা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাবেয়া বসরী বলেন, চরখানপুরে বিভিন্ন ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমাদের কর্মীরা সেখানে যান চিকিৎসা সেবা দিতে। এখানে কমিউনিটি ক্লিনিক নেই। বিষয়টি আমরা ঢাকায় জানিয়েছি।
এ বিষয়ে পবা হরিয়ান ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আবু জাফর ইবনে আলম বলেন, মৌলিক চাহিদার দুইটি অনুপস্থিত এই চরখানপুরে। এখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা একেবারে নাজুক। ২০০৪ সালের দিকে চরখানপুরে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ছিল। নদীভাঙনে সেটি বিলীন হয়ে যায়। এরপর ২০ বছর ধরে স্বাস্থ্যসেবার কোনো ব্যবস্থা নেই।
তিনি বলেন, এই আসনের সংসদ সদস্যকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তিনি ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছেন। এ চরে দু’জন গ্রাম্য চিকিৎসক রয়েছেন। তারা জ্বর, কাশির ওষুধ দেন। এ ছাড়া অন্য চিকিৎসার জন্য আমাদের চরবাসীকে রাজশাহী শহরে যেতে হয়। বিশেষ করে প্রসূতি মায়েদের বেশি সমস্যা হয়। অনেক সময় সন্তান প্রসবের সময় শিশু মারা যাওয়ার নজিরও রয়েছে।
শাহিনুল আশিক/এএএ