কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্য পাগলা মসজিদ
দেশজুড়ে খ্যাতি রয়েছে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের। প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক মসজিদটি শহরের পশ্চিমে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত। তিন তলা বিশিষ্ট মসজিটির নির্মাণশৈলী ও দৃষ্টিনন্দন বিশাল পাঁচতলা সমান মিনারগুলো সহজেই আকর্ষণ করে মুসল্লি ও পর্যটকদের। প্রায় ৪ একর জায়গার ওপর মসজিদটি নির্মিত। বর্তমানে দেশের অন্যতম বৃহৎ আয়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে পাগলা মসজিদ।
মসজিদটিতে আছে ১০টি লোহার দানবাক্স। প্রতি তিন মাসের বিরতিতে খোলা হয় দানবাক্সগুলো। টাকা ছাড়াও দানবাক্সে পাওয়া যায় বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার। তাই প্রতিবার দানবাক্স খুললেই আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে পাগলা মসজিদ।
অনেকের ধারণা এ মসজিদে দান করলে মনের বাসনা পূরণ হয়। মুশকিল আসান হয়, মেলে রোগ-ব্যধি থেকে মুক্তি। এই ধারণা থেকে দূর-দূরান্তের অনেকে ছুটে আসেন পাগলা মসজিদে। দান করতে এসে অনেকেই এখানে নামাজ আদায় করেন। জুমার নামাজে মসজিদে মুসল্লিদের ঢল নামে। এ সময় আশপাশের খোলা জায়গা, সেতু, সড়কেও চলে যায় নামাজের কাতার।
জনপ্রিয় এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে বেশকিছু জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। এর মধ্যে একটি হলো— একবার নরসুন্দা নদীর প্রবল স্রোতে মাদুর পেতে এক আধ্যাত্মিক পুরুষ ভেসে আসেন। তার আসন ছিল নদীর ঠিক মধ্যবর্তী স্থানে। বর্তমান মসজিদের কাছে এসে স্থির হন তিনি। এভাবেই কয়েকদিন কেটে যায়। ধীরে ধীরে নদীর সেই স্থানটিতে জেগে উঠে চরাভূমি। তিনি তখনো ইবাদতে মগ্ন ছিলেন। জেলেরা মাছ ধরতে এসে এ অলৌকিক দৃশ্য দেখতে পান। সবাই বিস্মিত এবং হতবাক হন। কেউ কাছে এগোনোর সাহস করেন না।
এরই মধ্যে মসজিদের বিপরীত দিকে অবস্থিত রাখুয়াইল গ্রামের এক গোয়ালা হঠাৎ লক্ষ্য করের তার পালিত গাভির ওলানে কোনো দুধ আসছে না। অনেক চেষ্টা করেও তিনি এক ফোঁটা দুধ পেলেন না। একদিন গাভিটি পাল থেকে বেরিয়ে নদী সাঁতরে সেই আধ্যাত্মিক ইবাদতকারীর চরে উঠে আসে। তার পাশে রক্ষিত একটি পাত্রে ওলানের সম্পূর্ণ দুধ ঢেলে দিয়ে গাভিটি আবার ফিরে যায়। পরপর কয়েকদিন এমন ঘটনা ঘটে।
সব দেখে গোয়ালা নিশ্চিত হন যে, এই ইবাদতকারী আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কেউ একজন হবেন। তাই গোয়ালা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কিছু দিনের মধ্যেই গোয়ালার সংসারে অভাবনীয় উন্নতি হতে থাকে। গোয়ালার উন্নতি দেখে আশপাশের জেলে-তাঁতি থেকে শুরু করে অনেকেই সেই ইবাদতকারীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরে শিষ্যদের মাধ্যমেই এ স্থানে গড়ে উঠে একটি হুজরাখানা। ইবাদতকারীর মৃত্যুর পর হুজরার পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে হুজরাখানার পাশেই নির্মিত হয় একটি মসজিদ; যা পরে পাগলা সাধকের নামানুসারে পাগলা মসজিদ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
মসজিদ প্রতিষ্ঠা নিয়ে আরেকটি জনশ্রুতি হচ্ছে— ঈশা খাঁর ৫ম পুরুষ হয়বত নগর এলাকার জমিদার দেওয়ান হৈবৎ খাঁর অধঃস্তন পুরুষ জোলকরন খানের স্ত্রী নিঃসন্তান ছিলেন, তিনি আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এই মসজিদটি স্থাপন করেন। জনসাধারণের কাছে পাগলাবিবি নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। তাই তার প্রতিষ্ঠিত মসজিদটির নাম রাখা হয় পাগলা মসজিদ।
মসজিদ প্রতিষ্ঠা নিয়ে তৃতীয় জনশ্রুতি হলো— দেওয়ান হৈবৎ খাঁর ধারাবাহিকতায় ঈশা খাঁর ৭ম পুরুষ দেওয়ান জিলকদর খাঁ সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে হয়বতনগরের জমিদার হয়েছিলেন। বংশ-তালিকার ধারাক্রমে জিলকদর খাঁ দেওয়ান হৈবৎ খাঁর পৌত্র বা দৌহিত্র ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। জমিদারিপ্রাপ্ত হলেও দেওয়ান জিলকদর খাঁর জমিদারির প্রতি কোনো মোহ ছিল না। তিনি জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বাইরে গিয়ে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকতেন।
সংসার বিমুখ উদাসী প্রকৃতির এই মানুষটি সবার কাছে ‘পাগলা সাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন। জমিদারির নৈমিত্তিক দায়িত্বের প্রতি তার কোনো মনোযোগ ছিল না। বর্তমানে যেখানে পাগলা মসজিদ রয়েছে প্রায় সময় তিনি সেখানে এসে ইবাদতে মগ্ন থাকতেন।
পরবর্তীতে জমিদারবাড়ির তত্ত্বাবধানে তার ইবাদতের জন্য এই স্থানে একটি ছোট মসজিদ তৈরি নির্মাণ করা হয়। মসজিদটির নামকরণ করা হয় ‘পাগলা মসজিদ’।
শুরুতে মাত্র ১০ শতাংশ ভূমির ওপর মসজিদ নির্মাণ করা হলেও বর্তমানে এর পরিধি যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে এর খ্যাতি ও ঐতিহাসিক মূল্য। বর্তমানে ৩.৮৮ একর ভূমির ওপর সম্প্রসারিত পাগলা মসজিদ এলাকায় একটি অত্যাধুনিক ধর্মীয় কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পাগলা মসজিদে মুসল্লিদের ব্যাপক সমাগমকে ঘিরে পুরাতন অবকাঠামো ভেঙে নতুন অবকাঠামো নির্মাণ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
পাগলা মসজিদে মানত করতে এসেছেন শামীম মিয়া। তিনি জানান, এখানে দান করলে আল্লাহ মনের আশা পূর্ণ করেন বলে শুনেছি। তাই এখানে আল্লাহর কাছে মনের বাসনা জানাতে এসেছি।
সাদিয়া আফরিন চাঁদনী বলেন, পাগলা মসজিদ আমাদের কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্য। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই এখানে আসেন। সবাই সাধ্যমতো দান করে আল্লাহর কাছে মনের বাসনা জানায়। আমি আরও দুই তিনবার এসেছি, আল্লাহর রহমতে ফল পেয়েছি।
সনাতন ধর্মের সুকুমার সাহা বলেন, পাগলা মসজিদে যে সময় শুধু ইট ছিল তখন থেকে আমি এখানে আসি। এখানে আমার ভালো লাগে। আমি অন্য ধর্মের হলেও পাগলা মসজিদের উপর বিশ্বাস আছে আমার।
জামালপুর থেকে মানত করতে এসেছেন এনামুল হাসান। তিনি বলেন, এখানে এসে নামাজ পড়েছি ও আল্লাহর কাছে মনের ইচ্ছার কথা জানিয়েছি।
ঈশ্বরগঞ্জ থেকে এসেছেন তোহরা বেগম। তিনি বলেন, আমার ছেলেকে নিয়ে এসেছি। নামাজ আদায় করেছি, মানত করেছিলাম, তার জন্য দান করেছি।
চাঁদ পেপার হাউসের মালিক ইকবাল হোসেন বলেন, পাগলা মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে অনেক দোকানপাট। আমরা সকলেই এখানে ব্যবসা করি। শুক্রবারে ব্যবসা ভালো হয়। আলহামদুলিল্লাহ, এর মাধ্যমে স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চলছে।
মসজিদ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, পাগলা মসজিদ মানুষের আবেগের জায়গা। মনের ইচ্ছা পূরণে অনেকেই এখানে দান করেন। মসজিদটিতে বর্তমানে মুসল্লিদের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। দানের টাকায় এখানে ৬ তলাবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্স হবে। যেখানে একসঙ্গে ৩০ হাজার মানুষ জামাতে নামাজ আদায় করবেন। এ লক্ষ্যে কার্যক্রম চলছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাগলা মসজিদে মানুষ টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, ফল-ফলাদি, কোরআন শরিফ ইত্যাদি দান করছেন। টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার মসজিদের দান সিন্দুকগুলোতে জমা পড়ে। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, ফল-ফলাদি, কোরআন শরিফ ইত্যাদি নিলামঘরে জমা দিতে হয়।
পাগলা মসজিদের মালামাল সংরক্ষক মো. বিল্লাল হোসেন জানান, প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ দান সিন্দুকে নগদ টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার দান করে। অনেকে মসজিদের নিলামঘরে নানা ধরনের জিনিসপত্র দান করেন।
নিলামঘরে প্রতিদিন এসব নিলামে বিক্রি করা হয়। এ নিলাম থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আসে। এ ছাড়া শুক্রবার নিলাম থেকে ২ লাখ টাকা থেকে ৪ লাখ টাকা আসে। এসব টাকা ব্যাংকে জমা করা হয়।
ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শওকত উদ্দীন ভূঞা বলেন, আমাদের এই মসজিদে গত ৯ ডিসেম্বর ১০টি সিন্দুক খোলা হয়। এতে ৬ কোটি ৩২ লাখ ৫১ হাজার ৪২৫ টাকা ছিল। স্বর্ণ অলংকার ছিল প্রায় ১২০০ গ্রামের ওপরে। বিদেশি মুদ্রা ছিল প্রায় ৮০০ পিস। এগুলো ট্রেজারিতে জমা আছে। এখানে মানুষ যেসব দান করেন। তা বিক্রি করা হয়। বিক্রির টাকা ব্যাংকে জমা রাখা হয়।
তিনি বলেন, এখানে আমরা ১৫০ কোটি টাকার ছয় তলা বিশিষ্ট একটি প্রকল্প করছি। আশা করি দ্রুত কাজ শুরু হবে। প্রতি তালায় ৫০০০ লোক নামাজ পড়তে পারবেন। আমরা গত অর্থ বছরের প্রায় ৪৯৬ জনকে কোটি টাকার মতো অনুদান দিয়েছি। এর মধ্যে ১৩৮ জন ক্যান্সার, প্যারালাইসিস, কিডনি, হার্ট ও জেনারেল রোগীকে অনুদান দেওয়া হয়েছে। মসজিদের সভাপতি জেলা প্রশাসক ও সদস্য সচিব পৌর মেয়রের পরামর্শে আমরা কাজ করি।
এনটি/আরএআর