ইমামতির বেতনে ভালো খাবার কেনা দুষ্কর
মুসলিম সমাজে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা। আজান-নামাজ শুরু করে মানুষের বিবাহ ও মৃত্যুতেও প্রয়োজন হয় তাদের। মানুষের কাছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও পৌঁছে দেন তারা। কোরআন-হাদিসের শিক্ষা সমাজে ছড়িয়ে দেন। খুব বেশি অসুস্থ না হলে সব প্রতিকূল পরিবেশেই দায়িত্ব পালন করতে হয় তাদের। যুগের পর যুগ নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেও তাদের বেশিরভাগই রয়ে গেছেন পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর তালিকায়।
মসজিদ কমিটি থেকে তাদেরকে যে বেতন দেওয়া হয় তা দিয়ে সংসার চালানোই যেন দায়। ‘আল্লাহ চালিয়ে নিচ্ছেন’ বলে নিয়তিকে মেনে নিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন ইমাম-মুয়াজ্জিনরা। সারাদেশের মতো ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জীবনমানের এমন চিত্র উত্তরের জেলা পঞ্চগড়েও।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তালিকা অনুযায়ী, পঞ্চগড় জেলায় মসজিদের সংখ্যা ২ হাজার ৭১২টি। তবে বেসরকারি তথ্যমতে, জেলায় মসজিদের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। স্থানীয় কমিটির মাধ্যমে আয়কৃত টাকা থেকে দেওয়া হয় মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিনদের বেতনভাতা। সেই আয় থেকে পরিচালিত হয় অন্যান্য কার্যক্রমও। জেলার পাঁচটি উপজেলা সরকারিভাবে করা হয়েছে পাঁচটি মডেল মসজিদ। এ মসজিদে সরকার নির্ধারিত বেতন পাচ্ছেন মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, জেলায় সরকারি পাঁচটি মডেল মসজিদে একজন ইমাম, একজন মুয়াজ্জিন ও দুইজন করে খাদেম রয়েছেন। ইমামরা মাসিক বেতন পাচ্ছেন ১৫ হাজার, মুয়াজ্জিন ১০ হাজার ও খাদেমরা ৭ হাজার ৫০০ টাকা করে বেতন পাচ্ছেন। তবে বেসরকারিভাবে গ্রামে-গঞ্জে যেসব মসজিদ রয়েছে সেগুলো সমাজের মসজিদ কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে তা। মসজিদ কমিটির মাধ্যমে ইমাম-মুয়াজ্জিনরা কেউ মাসে আবার কেউ বাৎসরিক এককালীন বেতন পেয়ে থাকেন।
তেঁতুলিয়ার উপজেলার বেশ কয়েকটি মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মসজিদ পরিচালনা কমিটি থেকে ইমাম-মুয়াজ্জিনরা যে বেতন পান তা দিয়ে সংসার চলছে না। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠেছে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের। দ্রব্যমূল্যে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও বেতন বাড়েনি তাদের। বেশিরভাগ দিনই পরিবার নিয়ে ডাল-সবজি খেয়ে জীবনযাপন করছেন তারা।
কয়েকটি মসজিদ ঘুরে জানা যায়, সমাজের সদস্যদের বাড়ি বাড়ি থেকে মসজিদের জন্য যে অর্থ আদায় করা হয় সেটা থেকেই ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন দেওয়া হয়। অনেক সমাজে সাপ্তাহিক মুষ্টির চাল তুলে তা বিক্রি করে মাস শেষে মুয়াজ্জিনের বেতন দেওয়া হয়। অনেক ইমামের বেতন বাৎসরিক। তাদেরকে মাঘ-ফাল্গুন মাসে বাৎসরিক নির্ধারিত ধান বা ধানের সমপরিমাণ টাকা দিয়ে বেতন দেওয়া হয়। এভাবেই চলছে গ্রামের মসজিদগুলোতে ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন কাঠামো। সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। শহরভিত্তিক মসজিদগুলোর বিভিন্ন খাত থেকে আয় থাকলেও গ্রামের মসজিদগুলোতে নেই তেমন আয়ের ব্যবস্থা। এতে করে গ্রামের মসজিদগুলোর ইমাম-মোয়াজ্জিনদের বেতন কম।
কথা হয় তেঁতুলিয়া উপজেলার দর্জিপাড়া গ্রামের জামে মসজিদের প্রবীণ ইমাম মো. আব্দুস সালামের সঙ্গে। দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে ইমামতি করছেন তিনি। ১৯৮৭ সালে বছরে ৬ মণ ধান দিয়ে শুরু হয়েছিল হাদিয়া বা সম্মানি ভাতা। এরপর বছরের পর বছর গেলেও আজ পর্যন্ত মাসিক বেতনভাতা নির্ধারণ হয়নি তার। বর্তমানে বছরে ২৬ মণ ধান পান। কয়েক বছর আগে মাদরাসার শিক্ষক থেকে অবসর নিয়ে এখন পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে চলছে নীরবে কষ্টের সংসার। বাড়ি থেকে মসজিদের দূরত্ব বেশি না হওয়ায় বাসা ভাড়া দিতে হয় না তার। বছরে ২৬ মণ ধান দিয়েই চালিয়ে যান পুরো বছর। ধান থেকে না হয় চাল হলো, কিন্তু অন্যান্য খরচ? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে মাসেও ভালো খাবার মিলে না পরিবারটির। ইমামতির এ হাদিয়াতেই চলে যাচ্ছে সংসার।
তেঁতুলিয়ার আরেক ইমাম মাওলানা মো. জামাল উদ্দিন জানান, ২০১১ সালে পঞ্চগড়ের চাকলাহাট থেকে তেঁতুলিয়ায় এসে মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব নেন। বর্তমানে তিনি তেঁতুলিয়া সরকারি কলেজ জামে মসজিদে ইমামতি করছেন। মসজিদ পরিচালনা কমিটি থেকে মাসে ৭ হাজার টাকা বেতন পান তিনি। স্বামী-স্ত্রীসহ দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে তার পরিবার। একটি মাদরাসাতেও শিক্ষকতাও করেন। সেখানেও পান সামান্য বেতন। এ বেতনে চলছে না চার সদস্যের সংসার। ছেলে-মেয়ে ছোট হওয়ায় ভর্তি করেছেন মাদরাসায়। দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে রীতিমতো লড়াই করে চলতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, এদেশে ইমামদের কদর খুবই কম। আয়ও সামান্য। এই আয়ে সংসার চালানো খুবই কঠিন। মসজিদ থেকে যে সম্মানি পাই তা দিয়ে পরিবার চালানো খুব কষ্টকর। রমজান মাস চলছে। ইচ্ছে হয় সেহরিতে মাংস কিনে পরিবার নিয়ে খাই। কিন্তু মাংসের যে দাম। ইফতারিতেও ফলমূল খেতে চায় ছেলে-মেয়েরা। কিন্তু ফলমূলেরও প্রচণ্ড দাম। এ বেতনে ভালো কিছু খাবার কেনা দুষ্কর। দিন চলে যাচ্ছে। আমরা তো একটি সমাজের মুসল্লিদের ইমামের নেতৃত্ব দেই। কষ্ট থাকলেও বলার উপায় নেই। তবুও আল্লাহ চালিয়ে নিচ্ছেন।
একই মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. জিসান। তিনি বিয়ে করেননি। নীলফামারী থেকে এসে মসজিদে মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করছেন। মাস শেষে ৫ হাজার টাকা পেলেও অভাবেই দিন কাটে তার।
রনচন্ডী বাজার জামে মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ ওমর ফারুক। তিনি হেফজ শেষ করে কয়েকটি মসজিদে ইমামতি করেছেন। বর্তমানে রনচন্ডী বাজার জামে মসজিদে পেশ ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বাড়ি মসজিদ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে আজিজনগর গ্রামে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে মসজিদে ইমামের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।এ মসজিদের খতিব ও মুয়াজ্জিনসহ রয়েছেন আরও চারজন। হাফেজ ওমর ফারুক এই মসজিদ থেকে মাসে বেতন পান ৭ হাজার টাকা। এই টাকায় পরিবারের চার সদস্য নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমি যেভাবে চলতেছি আল্লাহর রহমতে ভালোই চলতেছি। তবে আমি যে সাত হাজার টাকা বেতন পাই তা দিয়ে আমি আমার পরিবারের চাহিদা মেটাতে পারছি না। আর বাজারে যে জিনিসটা কিনতে চাচ্ছি সেটা কিনতে পারছি না। গত কয়েক দিন আগে বাজারে এক কেজি গোশত কিনতে গিয়েছি, দেখি গোশতের দাম হয়ে গেছে ৮০০ টাকা। ভাগ্য হয়নি আমার সে গোস্ত কেনার। ওই অবস্থায় বাড়িতে চলে আসি। কোনো রকম ভাবে খেয়ে চলছি। তারপর বাজারে তরমুজ আসছে। আমার ছেলে তরমুজ খেতে চাইছে। কিন্তু তরমুজের দাম ৮০ টাকা কেজি। এখন এই তরমুজ আমি কীভাবে কিনবো। তাই সরকারের কাছে আবেদন জানাবো, সরকার যাতে আমাদের এই দুঃখ-কষ্টগুলো বুঝে কিছু উদ্যোগ নেয়।
একই কথা বলেন, মসজিদের খতিব মাওলানা শহিদুল্লাহ। তিনি বলেন, আমি সাপ্তাহে জুমার নামাজ পড়াই। আমাকে মাসে তিন হাজার টাকা দেওয়া হয়। এতে তো সংসার চালানো দায়। কিন্তু কী করব, আল্লাহ যেভাবে চালাবে, সেভাবেই তো চলতে হবে।
এ মসজিদের মুয়াজ্জিনের দায়িত্বে রয়েছেন সাগর নামে এক মাদরাসা ছাত্র। মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সুমধুর আজানের কণ্ঠ তার। মাদরাসার পড়ার পাশাপাশি মসজিদে আজানের দায়িত্ব পালন করে মাসে দেড় হাজার টাকা বেতন পায় সে। বাড়িতে তার বাবা ক্যান্সারের রোগী। একদিকে পরিবারের চিন্তা, আরেকদিকে নিজের পড়ালেখা করে বড় হওয়ার লড়াই। দুই কষ্টে চলছে দেড় হাজার টাকার বেতনে। ঈদে তার কাপড়ের অভাব। এই বেতনের টাকা পরিবারকে দেবে, নাকি তার নতুন জামা কিনবে?
সাহেবজোত বায়তুন নুর জামে মসজিদের ইমাম হামিদুর রহমান। নওগাঁর সাপাহার এলাকা থেকে এসে তেঁতুলিয়ায় একটি মাদরাসার শিক্ষকতার পাশাপাশি এই মসজিদে ইমামতি করছেন। পরিবারে তারও চার সদস্য। স্ত্রী ও ছোট দুই ছেলেমেয়ে রয়েছে। মাদরাসায় পড়াচ্ছেন। এ মসজিদ থেকে বেতন পাচ্ছেন ৮ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, আমরা যারা মসজিদে চাকরি করি আমাদের বেতন অনেক কম। একজন দিনমজুরের ইনকামও আমাদের থেকে অনেক বেশি। সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধাও আমরা পাই না। যাদের চলার সামর্থ্য নেই তারা মসজিদেই থাকে। যে টাকা সম্মানি দেওয়া হয় তা দিয়ে কোনোভাবেই সংসার চলে না। তবুও আল্লাহ চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বিষয়টিতে যদি সরকার নজর দিতো তাহলে ভালো হতো।
তেঁতুলিয়া সরকারি কলেজ মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোজাফফর রহমান বলেন, আমরা মসজিদ পরিচালনা কমিটির পক্ষ হতে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের যে বেতন দেই তা দিয়ে কিন্তু তাদের সংসার চলে না। চলার কথাও না। বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সবকিছুরই দাম বেশি। এ বেতনে তাদের চলার কথা না। এই যে রমজান মাস, এ মাসে যারা তারাবি পড়াচ্ছেন, তারা সম্মানি পাবেন। কিন্তু বাকি সময়গুলো তাদের খুব কষ্টে কাটাতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ইমাম-মুয়াজ্জিনদের প্রতি সরকারের নজর দেওয়া উচিত। তাদের জন্য বেতনভাতার ব্যবস্থা করা দরকার। বেতন কম। তবুও অনেকে চক্ষুলজ্জার কারণে চুপ থাকেন। ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের উপযুক্ত সম্মানি দেওয়া হলে তারা মানসিক অস্থিরতা ও আর্থিক দুবর্লতা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
তেঁতুলিয়ার রনচন্ডী বাজার জামে মসজিদের সভাপতি নাইবুল ইসলাম বলেন, আমাদের মসজিদে পাঁচজন লোক কর্মরত রয়েছেন। উনাদেরকে আমরা যে সম্মানি ভাতাটুকু দেই তা বর্তমান যুগে অতি নগণ্য। একজন দিনমজুরের বেতন ৫০০ টাকা। আর আমার ইমামের বেতন দিনপ্রতি ২২০ টাকা, মুয়াজ্জিনের ২০০ টাকা, খাদেমের ১০০ টাকা। এই দিয়ে তাদের সংসার চলে না। পকেট খরচও হয় না। এটা বলতে গেলেও খারাপ লাগে। রাষ্ট্রের যে অপচয় হচ্ছে সেটা যদি ইমাম-মসজিদের জীবনমান উন্নয়নে কাজে লাগানো যায় তাহলে তারা ভালোভাবে চলতে পারতেন। সরকারের কাছে মসজিদগুলোর ইমাম-মুয়াজ্জিনের প্রতি নজর দেওয়ার অনুরোধ জানাই।
পঞ্চগড় ইসলামি ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মো. রেজাউল করিম বলেন, আমাদের পঞ্চগড় জেলায় মোট মসজিদ রয়েছে ২ হাজার ৭১২টি। তার মধ্যে পাঁচ উপজেলায় পাঁচটি সরকারি মডেল মসজিদ রয়েছে। সরকারি মসজিদগুলোতে ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা নির্ধারিত সরকারি বেতন পাচ্ছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন সারাদেশে ৮টি ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির মাধ্যমে ইমামদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করতে সহযোগিতা করে থাকে। তবে গ্রামের মসজিদগুলোতে ইমাম-মুয়াজ্জিনরা পিছিয়ে রয়েছেন। তাদেরকে সমাজ থেকে মসজিদ পরিচালনা কমিটি দান-খয়রাতের টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে বেতনভাতা দিয়ে থাকে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইমামদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট করে দিয়েছেন। এ ট্রাস্টে ইমামরা সদস্য হয়ে নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করলে তাদের আর্থিক সুবিধা ও সুদমুক্ত ঋণ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। ২০২০ সালে ২ হাজার ৪৩৭ জন ইমামকে আর্থিক সুবিধা হিসেবে ৫ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছিল।
আরএআর