‘একটা কাম কইরা যদি ৩-৪ হাজার টেহা না পাই, তাইলে করারই দরকার নাই’
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই হয় না। সেবা নিতে গেলে প্রতিটি পদে পদে কর্তা বাবু ও তার সহকারীকে ঘুষ দিতে বাধ্য হন সেবাগ্রহীতারা। এমন এক সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে ঘুষের পাঁচ হাজার টাকা গুনে নেন ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের সহকারী আবদুল কাদির মিয়া। ঘুষ নেওয়ার সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় ওই কর্মচারীকে উপজেলা ভূমি কার্যালয় থেকে কারণ দর্শানোর চিঠি (শোকজ) দেওয়া হয়েছে।
ভিডিওতে দেখা যায়, আবদুল কাদির মিয়া তার দপ্তরে বসে প্রকাশ্যে সেবা নিতে আসা ভোলা মিয়ার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা গুনে নিচ্ছেন। এ সময় ভোলা মিয়া বলছেন, সব খারিজ তো আর সমান না। গরিব মানুষ কাজটা করে দেন। এ সময় আব্দুল কাদির বলেন, ‘কথা আছিল ৬ হাজার টেহা দিবাইন। পরে দিলেও টেহা দেওন লাগব। একটা কাম কইরা যদি তিন-চার হাজার টেহা না পাই, তাইলে করারই দরকার নাই।’ এরপর টাকাগুলো গুনে পকেটে নেন আব্দুল কাদির। এরপর চলে যাওয়ার সময় ভোলা মিয়া আবারও বলেন, ‘আপনি আরও এক হাজার টাকার আবদার করেছেন একটা বিহিত হবে। আপনি কাজটা করে রাখুন।’
ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এলাকাবাসী। ভূমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন তারা। বলছেন ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ করেন না ভূমি কর্মকর্তা মীর আবুল হাতিম ও অফিস সহকারী আব্দুল কাদির।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, নাম প্রস্তাব, সার্ভে রিপোর্ট, নামজারি, ডিসিআর সংগ্রহ, মিস কেস ও খাজনা দাখিল থেকে শুরু করে সবকিছুতেই মাইজখাপন ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ঘুষের কারবার চলছে সমানতালে। জমির দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঘুষ লেনদেন। এখানে দালালদের সিন্ডিকেট অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।
ভুক্তভোগীদের আরও অভিযোগ, বৈধ কাজে গিয়েও প্রকৃত মালিকদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। অসাধু অফিস সহকারী ও ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করে খারিজ পার করতে হয়। জমির মালিকরা টাকা দিয়েও জমি খারিজ করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ ইউনিয়ন ভূমি অফিসে দালাল উৎপাতও বেশি। সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। তবে টাকা দিলে তদন্ত প্রতিবেদন, সার্ভে রিপোর্ট আর নামজারি খতিয়ানের অবৈধ কাগজ বের করা কোনো ব্যাপারই না।
স্থানীয় বাসিন্দা ভুক্তভোগী নুরুল ইসলাম বলেন, আমরা সাধারণ মানুষের যেটা জানি জায়গা খারিজ করতে তিন হাজার টাকার মত লাগে সেখানে দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা দিতে হয়। শুধু তাই নয় টাকা নিয়েও কাজ করে দিতেও হয়রানি করে। তাদের পেছনে দীর্ঘদিন ঘুরতে হয়। বেশি দিন হয়রানি করলে টাকার অংকও বেড়ে যায়।
মো. নজরুল ইসলাম নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, নামজারি, ডিসিআর সংগ্রহ, মিস কেস ও খাজনা দাখিলের জন্য গেলে আগেই বলে দেয় কোনটার জন্য কতটাকা দিতে হবে। টাকা দিতে বিলম্ব করলে তারা কথা বলে না। ১৪৪ ধারা মামলার রিপোর্টের জন্য আসলে টাকা ছাড়া রিপোর্ট করে না। অফিস প্রধান ও অফিস সহকারী টাকা ছাড়া বিকল্প কিছু বুঝে না। কয়েক দিন আগেও আড়াই হাজার টাকার কাজ ৬ হাজার টাকা দিয়ে করিয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নাই। তাদের হাতে মাইজখাপন ইউনিয়নের মানুষ জিম্মি হয়ে আছে। এরা একচেটিয়া দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, আব্দুল কাদিরের শুধু গ্রামে নয় ঢাকাতেও বাড়ি রয়েছে। গ্রামের এই সুসজ্জিত বাড়িটিতে নিরাপত্তারও কোনো কমতি রাখেননি। ১৯৯৭ সালে পল্লী বিদ্যুতের চাকরি ছেড়ে ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক চাকরিতে যোগদান করেন আব্দুল কাদির। এরপর থেকে ফুলে ফেঁপে বাড়তে থাকে অর্থ সম্পদ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা মীর আবুল হাতিম বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা আর অফিস সহকারী আব্দুল কাদিরের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অফিস সহকারী আব্দুল কাদির বলেন, ইতোমধ্যে আমাকে শোকজ করেছে। আমি এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে পারব না।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাকিবুল ইসলাম বলেন, ঘুষ নেওয়ার ভিডিও প্রকাশের পর অভিযুক্ত আব্দুল কাদিরের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি জানানো হয়েছে। ব্যাখ্যা পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মোহাম্মদ এনামুল হক হৃদয়/এএএ