সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ ঐতিহাসিক ‘নারী মসজিদ’
শুধু নারীদের নামাজের জন্য আলাদা মসজিদ নির্মাণের ঘটনা সচারচর চোখে পড়ে না। তবে রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় এমন একটি মসজিদের দেখা মিলবে, যেখানে শুধু নারীরাই নামাজ আদায় করেন। তাই মসজিদটির নামও রাখা হয়েছে ‘নারী মসজিদ’। প্রায় ৫০০ বছর আগে কোনো এক সময় মসজিদটির মোতাওয়াল্লি (ষষ্ঠ রইশ) রইশ পরিবার ও এলাকার পর্দানশীন নারীদের জন্য এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ নারী মসজিদ
কয়েকশ বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে টিকে থাকা নারী মসজিদের শৈল্পিক স্থাপনাজুড়ে এখন শুধুই অযত্ন-অবহেলার ছাপ। ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সভ্যতার প্রাচীন এই নিদর্শনটি বর্তমানে সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। জরাজীর্ণ মসজিদটিতে দর্শনার্থীদের কেউ কেউ এখনো নামাজ আদায় করেন।
সংশ্লিষ্টদের দাবি— ঐতিহাসিক বাঘা মসজিদ ১৫২৩ থেকে ১৫২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। তৎকালীন সময়ে নারী মসজিদটিও নির্মিত হয়। সেই হিসেবে বর্তমানে মসজিদটির বয়স প্রায় ৫০০ বছর।
মসজিদের দেয়ালের বেশিরভাগ অংশে ধসে পড়েছে পলেস্তারা। বর্তমানে মসজিদটি ধ্বংসের পথে। আবার সংস্কার করে মসজিদটি চালুর দাবি এলাকাবাসীর।
নারী মসজিদের নির্মাণ কাঠামো
তিন গম্বুজ বিশিষ্ট নারী মসজিদটির নির্মাণ কাঠামো অন্যসব মসজিদের মত নয়। এই মসজিদ নির্মাণে ইট গাঁথুনিতে বালুর পরিবর্তে চুন ও সুড়কি ব্যবহার হয়েছে। মসজিদের ইটের রঙ ধূসর বর্ণের। তবে বর্তমান যুগের ইটের চেয়ে এর আকৃতি আলাদা। ইটের দৈর্ঘ্য ১০ ইঞ্চি, প্রস্থ ৬ ইঞ্চি এবং চওড়া দেড় ইঞ্চি করে। ছোট্ট এই মসজিদটিতে তিনটি দরজা রয়েছে। পূর্ব দিকে রয়েছে প্রবেশপথ। জানালা রয়েছে দুটি। জানালা দুটি মসজিদের মাঝ বরাবর উত্তর-দক্ষিণে। তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির অবস্থান প্রায় ৩০ ফুট সুউচ্চ। বর্গাকার দৈর্ঘ্য ২৭ ফুট, প্রস্থ ১৩ ফুটের মতো। চারপাশের দেয়াল ৩ ফুটের বেশি চওড়া। মসজিদটির প্রবেশ পথের মূল দরজায় ফারসি ভাষায় লেখা একটি পাথর রয়েছে।
নারী মসজিদ দেখতে এখনো আসেন দর্শনার্থীরা
বছরজুড়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে মসজিদটি দেখতে আসেন পর্যটক ও দর্শনার্থীরা। স্থানীয় ও দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা আবারো আগের চিরচেনা রূপে দেখতে চান নারী মসজিদ। তাদের দাবি- বাঘা শাহী মসজিদের মতো পুরোনো এই মসজিদটিও সংস্কার করা হোক।
নারী মসজিদের অবস্থান ও নির্মাণের ইতিহাস
ঐতিহাসিক তথ্যমতে, বাঘা উপজেলা সদরে হজরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলার (রহ.) ছেলে হজরত শাহ আউল হামিদ দানিশ মন্দ (রহ.) মাজার সংলগ্ন এলাকায় মসজিদটি অবস্থিত। পাশেই হজরত জহর শাহর (রহ.) মাজার। প্রায় ৫০০ বছর আগে পাঁচজন সঙ্গীসহ সুদূর বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য বাঘায় এসেছিলেন হজরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (রহ.)। তিনি বসবাস শুরু করেন পদ্মা নদীর কাছে কসবে বাঘা নামক স্থানে। শাহদৌলা (রহ.) আধ্যাত্নিক শক্তির বলে এ এলাকার জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচারে ব্যাপক সাফল্য পান। তার অলৌকিক কীর্তি দেখে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেন।
বাঘা ওয়াকফ এস্টেটের দেওয়া তথ্য মতে, হজরত শাহদৌলার (রহ.) ছেলে হজরত শাহ আবদুল হামিদ দানিশ মন্দর (রহ.) মৃত্যুর পরে তৃতীয় ছেলে মাওলানা শাহ আবদুল ওয়াহাব (রহ.) বাঘার খানকার দায়িত্বভার নেন। সেই সময় ১০৩০ হিজরিতে দিল্লির সম্রাট শাজাহানের প্রেরিত শাহী ফরমানযোগে ৪২টি মৌজা মাদদ মাস স্বরূপ দান লাভ করেন। তখন শালিমানা ছিল ৮ হাজার টাকা।
হজরত আবদুল ওয়াহাবের মৃত্যুর পর তার দুই ছেলের মধ্যে হজরত শাহ মোহম্মদ রফিক (রহ.) ১০২৮ হিজরি সনে ২০৩৭ আনা শালিমানার সম্পত্তি ওয়াকফ করেন। ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি (ষষ্ঠ রইশ) সাইজুল ইসলামের আমলে রইশ পরিবার ও এলাকার পর্দানশীন নারীদের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে মসজিদটি বাঘার নারী মসজিদ নামে পরিচিতি পায়।
স্থানীয়দের বক্তব্য
৬৫ বছর বয়সী রেশমা বেগম বলেন, জন্মের পর থেকে দেখছি মসজিদটি। এখনো এখানে দূর-দূরান্ত থেকে আসা নারীরা নামাজ আদায় করেন। নারীদের জামাতে নামাজ আদায়ের জন্য আমরা স্থানীয়ভাবে মসজিদটি সংস্কারের দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
তিনি আরও বলেন, বাইরে থেকে মানুষ এসে মসজিদে মানত করে। অনেকে মসজিদের পাথরের গায়ে পানি ছিটিয়ে দেন। এরপর পাথর থেকে গড়িয়ে পড়া পানি পান করেন। অনেক নারী এখানে এসে নফল নামাজ আদায় করেন।
বগুড়ার শেরপুর থেকে আসা আশমানী বেগম (৪৫) স্থানীয়দের মুখে শুনে মসজিদটি দেখতে এসেছেন প্রথমবার। তিনি বলেন, নফল নামাজ পড়ার নিয়তে এসেছিলাম। কিন্তু মসজিদের পরিবেশ অপরিচ্ছন্ন। নামাজ পড়ার কোনো পরিবেশ নেই ভেতরে। তাই মসজিদটি দেখেই চলে যাচ্ছি।
নারী মসজিদ নিয়ে লোমহর্ষক ঘটনা
মসজিদটির প্রবেশ পথের মূল দরজায় একটি পাথরে ফারসি ভাষায় লেখা রয়েছে। পাথরটি একবার চুরি হয়ে যায়। চুরির ঘটনায় জড়িত ছিলেন ছয়জন। তাদের সবাই বর্তমানে মারা গেছেন। তবে তাদের মারা যাওয়া নিয়ে লোকমুখে বিভিন্ন কথা প্রচলিত রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. সোহেল হোসেন বলেন, ১৯৯০ সালে নারী মসজিদের প্রধান ফটকের পাথরটি (ফারসি ভাষার লেখা) চুরি হয়ে যায়। পাথরটি বিক্রি করার আগেই তিনজনের পায়ে পচন ধরে তারা মারা গেছেন। আর তিনজন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
তিনি বলেন, নারী মসজিদটি মাজার কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। নিরাপত্তা, সংস্কারের অভাবে এখানে তেমন কেউ নামাজ পড়ে না।
মসজিদটি সংস্কারের দাবি
বাঘা ওয়াকফ এস্টেটের বর্তমান মোতাওয়াল্লি খন্দকার মুনসুরুল ইসলাম রইশ বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে মসজিদটি পরিদর্শন করে গেছে। সম্ভবত তালিকাভুক্ত হয়েছে। মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণ ও পুরোনো নকশা অক্ষুণ্ন রেখে সংস্কারের দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বাঘা জাদুঘরের মডেলার (সংযুক্ত) মো. এনায়েত হোসেন বলেন, বাঘার নারী মসজিদ ও বাঘা শাহী মসজিদ এক সময়ের না। বাঘা নারী মসজিদ তার কিছু বছর পরে তৈরি করা হয়েছে। ধারণা করা হয় ৩০০ বছর পুরোনো এই মসজিদটি। তবে অনকে বলেন এর বয়স আরও বেশি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব এবং খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল আলম বলেন, নারী মসজিদটির বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে তৎকালীন সময় ইসলাম প্রচারের জন্য যারা এসেছেন তারা শুধু পুরুষদের নামাজের জন্য বলেননি নারীদেরও বলেছেন। তারই নির্দশন এই নারী মসজিদ বলে মনে করি। বিভিন্ন দেশে মসজিদে নারীদের নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। তবে মসজিদে নারীদের নামাজের ব্যবস্থা থাকা দরকার।
বাঘা মসজিদের বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী, রংপুর বিভাগ ও বগুড়ার অঞ্চলিক পরিচালক ডা. নাহিদ সুলতানা বলেন, নারী মসজিদটি নিয়ে অধিদপ্তরে আবেদন পাঠানো হয়েছে। গেজেট পাস হলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে আসবে। তখন সংস্কার ও যাবতীয় ব্যবস্থা নেবে অধিদপ্তর।
এনটি/আরএআর