কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৪১৪ বছরের আতিয়া মসজিদ
বাংলাদেশে সুলতানি এবং মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত যেসব স্থাপত্য রয়েছে, তার মধ্যে টাঙ্গাইলের আতিয়া মসজিদ অন্যতম। এই মুসলিম স্থাপত্যটি প্রায় ৪১৪ বছর আগে নির্মিত হলেও মসজিদটির কারুকাজ এখনো সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মসজিদটি দেখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন। সব মিলিয়ে আতিয়া মসজিদ যুগসন্ধিলগ্নের স্থাপত্য ও নিদর্শনরূপে পরিচিত।
জানা যায়, মসজিদটির ভেতরে পাঁচটি কাতারের প্রতিটিতে ১৮ জন করে ৯০ জন এবং মসজিদের বারান্দায় ৩৬ জন মুসুল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। এ ছাড়া মসজিদের বাইরে আরও প্রায় ৫০০ জনের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
আরও পড়ুন
টাঙ্গাইল শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে আট কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক আতিয়া মসজিদটির অবস্থান। ১৯৭৮ সালে ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদে প্রথম আতিয়া মসজিদটি স্থান পায়। এরপর ১৯৮২ সালে পরিবর্তিত ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদেও স্থান পায় আতিয়া মসজিদ। এতে দেশবাসীর কাছে সহজেই মসজিদটি পরিচিতি লাভ করে। তবে আজকাল দশ টাকার পুরাতন নোটটি তেমন দেখা যায় না। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৭৮ সালে মসজিদটির দেখভালের দায়িত্ব নেয়।
জানা গেছে, পঞ্চদশ শতকে এই অঞ্চলে আদম শাহ বাবা কাশ্মীরি নামের এক সুফি ধর্মপ্রচারক আসেন। ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। এই পুণ্যবান ব্যক্তির কবর এখানেই অবস্থিত। শাহ কাশ্মিরীর অনুরোধে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর সাঈদ খান পন্নীকে আতিয়া পরগণার শাসক নিয়োগ করা হয়। সাঈদ খান পন্নীই করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন। ‘আতিয়া’ শব্দটি আরবি ‘আতা’ শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ হলো ‘দান’। ওই সময় ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয়ভার বহনের জন্য কররানি শাসক সোলাইমান কররানির কাছ থেকে বিশাল একটি এলাকা ‘ওয়াকফ’ হিসেবে পান।
সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্য শিল্পরীতির সমন্বয়ে নির্মিত এ মসজিদের পরিকল্পনা ও নির্মাণকাজে নিযুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ। নির্মাণের পর ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরী ও ১৯০৯ সালে আবুল আহমেদ খান গজনবি মসজিদটি সংস্কার করেন বলে জানা যায়।
প্রাচীন এই মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ১৮.২৯ মিটার ও প্রস্থে ১২.১৯ মিটার। মসজিদের দেওয়ালের পুরুত্ব ২.২৩ মিটার ও উচ্চতা ৪৪ ফুট। মসজিদের চারকোণে চারটি অষ্টকোণাকৃতির মিনার রয়েছে। মসজিদটির প্রধান কক্ষ ও বারান্দা দুই ভাগে বিভক্ত। মসজিদের পূর্ব ও মাঝের দেওয়ালে রয়েছে একটি করে দরজা। বারান্দাসহ উত্তর-দক্ষিণ দেওয়ালে রয়েছে দুটি করে দরজা। ভেতরের পশ্চিম দেওয়ালে আছে তিনটি সুন্দর মিহরাব। প্রধান কক্ষের প্রত্যেক দেওয়ালের সঙ্গে দুইটি করে পাথরের তৈরি স্তম্ভ রয়েছে। প্রধান কক্ষের উপরে রয়েছে একটি বিশাল মনোমুগ্ধকর গম্বুজ। বারান্দার পূর্ব দেওয়ালে রয়েছে তিনটি প্রবেশপথ। মাঝখানের প্রবেশপথের উপরের অংশের নিম্নভাগে একটি শিলালিপি রয়েছে। বর্তমানে যে শিলালিপিটি রয়েছে এর আগেও সেখানে একটি শিলালিপি ছিল বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। এই শিলালিপিটি ফার্সিতে লেখা। কোনো কারণে আদি শিলালিপিটি বিনষ্ট হলে পরবর্তীকালে মসজিদ মেরামতের সময় বর্তমান শিলালিপিটি লাগানো হয়। মসজিদটি টেরাকোটার ইটের তৈরি। চুন, সুরকি গাঁথুনি দিয়ে মসজিদটি নির্মিত। সুলতানি আমলে প্লাস্টার পদ্ধতি ছিল না। তাই তারা চুন ও সুরকির গাঁথুনি দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করত।
আতিয়া মসজিদের নাম একবার হলেও শোনেনি এমন ব্যক্তি হয়তো খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। শত বছরের প্রাচীন মসজিদটি চালুর পর থেকে রোজ নামাজ আদায় চলছে।
দর্শনার্থীরা ঢাকা পোস্টকে জানান, মসজিদটি শুধু ঐতিহ্যের নিদর্শনই নয়, একটি দর্শনীয় স্থানও। কারিগররা মন্ত্রমুগ্ধকর কাজ করেছেন। এটি ধরে রাখা দরকার।
নামাজ পড়তে আসা মুসল্লি বাদল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মসজিদটিতে বেশি মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে না। মসজিদের বাইরে নামাজ পড়তে হয়। উদ্যোগ নেওয়া দরকার যাতে বেশিসংখ্যক মুসুল্লি এখানে নামাজ আদায় করতে পারেন।
আরও পড়ুন
মসজিদ কমিটির সদস্যরা জানান, সুলতানি ও মোঘল আমলের স্থাপত্যটি দেখতে প্রতিনিয়ত দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীরা আসেন। তবে মসজিদটির সংস্কার প্রয়োজন। সম্প্রতি যা সংস্কার করা হয়েছে তা বেশিদিন টেকসই হবে না। এখানে রমজান মাস ও শুক্রবারে বেশি দর্শনার্থী আসেন।
মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান ইমরান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভেতরে শতাধিক মুসুল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকার কারণে জুমার দিন বেশি সমস্যা হয়। মসজিদ কমিটিসহ এলাকার সকলে মিলে জায়গা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদের নকশা নষ্ট হবে মর্মে সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে দেয়নি।
এমজেইউ