‘ইফতার-সেহরির কথা মনে পড়লে বুকের মধ্যে কেঁদে ওঠে’
‘ঘরবাড়ি, পরিবার-পরিজন থেকেও নাই। আগে সবাই একসাথে ইফতার করতাম। এখন ইচ্ছে থাকলেও পারি না। আর সম্ভবও না। কারণ আমি চাইলেও তারা চায় না। যদি চাইতো তাহলে ঈদের দিনে মুখটা দেখে বলে আসতো। কিন্তু কেউ আসে না। পরিবার নিয়ে ইফতার-সেহরির কথা মনে পড়লে বুকের মধ্যে কেঁদে ওঠে।’
কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ৬৫ বছর বয়সী সুফিয়া বেগম। তার বাড়ি নাটোরের সিংড়া উপজেলায়। কিন্তু সুফিয়া বেগমের সেখানে জায়গা হয়নি। তিন বছর ধরে আছেন রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার শিলমারী ইউনিয়নের সাধানপুর গ্রামে ‘বয়স্ক প্রতিবন্ধী নিরাশ্রয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে’। শুধু সুফিয়া বেগম নয়, তার মতো আরও ১০ জন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের আশ্রয় হয়েছে এখানে।
সুফিয়া বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। এক মেয়ে মারা গেছে, এক মেয়ে পরের সংসারে থাকে। পুত্রবধূ অত্যাচার করে। ঠিক মতো খেতে দেয় না। আমাকে বোঝা মনে করে। আমার পাতে ভাত তুলতে চায় না। এ নিয়ে ছেলের সঙ্গে বউয়ের মাঝে মাঝে অশান্তি হয়। তাই নিজেই চলে এসেছি এখানে। এখানকার মানুষগুলো পরিবারের মতো হয়ে গেছে। তাদের সাথে ইফতার ও সেহেরি করি। একসঙ্গে থাকি।
বৃদ্ধাশ্রমে থাকা নিবাসীরা জানান, তাদের মধ্যে অনেকেই রোজা রাখেন। সেখানে দুইজন হিন্দু ধর্মালম্বী রয়েছেন। তারাও তাদের ইফতার করেন। সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে থাকেন। তাদের ইফতারের সঙ্গে রাতের খাবার চলে আসে। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মানুষগুলো ইফতার শেষে সেখানে মসজিদে নামাজ আদায় করে রাতের খাবার খেয়ে নেন। আর সেহরির খাবার আসে সাড়ে ৩টার দিকে। তারপর একসঙ্গে তারা সেহরি খেয়ে নেন।
এই বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা নাটোরের ভ্রম্যপুরের ইসমাইল হোসেন (৬৭)। তিনি এখানে আছেন ছয় মাস ধরে। স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়ে তার। কিন্তু কেউ কাছে নেই। সন্তানরা নিজেদের ইচ্ছে মতো রয়েছে। স্ত্রী কাজ করেন ঢাকায় গার্মেন্টসে। ৪০ বছর পরিবার নামের ঘানি টেনে তার জায়গা হয়নি সেই পরিবারেই।
ইসমাইল হোসেন বলেন, কিছু দিন ধরে বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছিল। তাই গত সপ্তাহে বাড়িতে গিয়েছিলাম। বাড়ির আশপাশের মানুষ আমার (ইসমাইল) সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু পরিবারের মানুষ আমার (ইসমাইল) সঙ্গে কথা বলেনি। বউরা তো দূরের কথা ছেলে ও নাতিরাও কথা বলেনি। বাড়ির আশপাশে ঘুরে বেড়ালাম। এরপরে যে ঘরে থাকতাম সেই ঘরে গেলাম। ঘর আছে মানুষ নেই। দীর্ঘদিন মানুষের বসবাস না থাকায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ বসে আবার বেরিয়ে আসলাম। কিন্তু কেউ কথা বলল না।
বৃদ্ধাশ্রম দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা নাসির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, তাদের বয়স হয়েছে। তারপরও অনেকেই রোজা থাকেন। ইফতারে তাদের মুড়ি, ছোলা, খেজুর, পেঁয়াজু, বেগুনি, আখের রস দেওয়া হয়। আমরা সাধারণত ইফতারের সময় রাতের খাবার নিয়ে চলে আসি। ইফতার শেষে তাদের রাতের খাবার দিয়ে দেওয়া হয়। আর সেহরি রাতে নিয়ে আসা হয়।
পঙ্গু শিশু নিকেতনের সভাপতি মো. মুরছালাত বলেন, এখানে অনেকেই রোজা রাখেন। সেহরি থেকে শুরু করে ইফতার পর্যন্ত সব ব্যবস্থা এখানে রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে সরকারিভাবে সহযোগিতা পাই না। নিজস্ব আয়ের কিছু উৎস আছে যেমন- পুকুর, ধানি জমি ও বিভিন্ন ফলের গাছ ইত্যাদি। সেই টাকায় কোনো মতে চলে। আমরাও এর চেয়ে ভালো সেবা দিতে চাই এই মানুষগুলোকে। কিন্তু আর্থিক সংকট ছাড়াও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে হয়ে ওঠে না। সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
পুঠিয়া উপজেলার শিলমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন মুকুল বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তি উদ্যোগে কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। পঙ্গুদের শিক্ষা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ থাকেন। সরকারি বা এনজিওগুলোর সহযোগিতা পেলে এটি ভালোভাবে চলতো।
শাহিনুল আশিক/আরএআর