‘মেসের ইফতারিতে আপেল-তরমুজ খাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না’
‘গত বছর আমাদের ইফতারে এক টুকরা করে হলেও তরমুজ, আপেল, মাল্টা বা অন্যকোনো ফল থাকত। সঙ্গে থাকত লেবুর শবরত। এবার সব জিনিসের দাম বেশি। লেবু কেনার উপায় নেই। খেজুর, আপেল আর তরমুজ খাওয়ার কথা তো ভাবতেই পারি না।’
এভাবেই বলছিলেন ফরিদপুর শহরের পূর্ব খাবাসপুর মহল্লায় অবস্থিত একটি ছাত্রাবাসের (মেস) বাসিন্দা স্নাতক শেষ করে চাকরিপ্রার্থী সুজন মাহমুদ (২৮)। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, অতিরিক্ত দামের কারণে এবার এসব ফল বা লেবু কেনা সম্ভব হচ্ছে না। ফলের মধ্যে শুধু জনপ্রতি কোনোরকম একটা করে খেজুর আর আঙুর রাখা হচ্ছে। তাও মাঝেমধ্যে সম্ভব হয় না।
সুজনের মেসে মোট লোকজনের সংখ্যা নয়জন। এরা আশপাশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে পড়াশোনা কিংবা চাকরির খোঁজে মেস করে আছেন। সুজন মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বাসিন্দা। গত দেড় বছর ধরে তিনি এই মেসে আছেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফরিদপুর ছাড়াও রাজবাড়ী, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, শরীয়তপুর, মাগুরাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থীরা ফরিদপুর শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে আসেন। এদের বেশির ভাগই সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী। এ ছাড়া সরকারি ইয়াছিন কলেজ, সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজ, ফরিদপুর সিটি কলেজ, ফরিদপুর মহাবিদ্যালয়, কৃষি কলেজ, ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর প্রকৌশল কলেজ, ফরিদপুর সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ফরিদপুর ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ফরিদপুর মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টসহ (ম্যাটস) আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত অর্ধলাখ শিক্ষার্থী ফরিদপুরে পড়াশুনা করে থাকেন। এরা শহরের বাইতুল আমান, কমলাপুর, চরকমলাপুর, দক্ষিণ ঝিলটুলী, পূর্ব খাবাসপুর, পশ্চিম খাবাসপুর, আলীপুর, লালেরমোড় এলাকার বিভিন্ন সেমিপাকা ও পাকা বাড়ি ভাড়া নিয়ে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় মেস হিসেবে বসবাস করেন। ফরিদপুরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য আসনসংখ্যা খুবই কম হওয়ায় বাধ্য হয়েই শিক্ষার্থীদের এসব মেসে থাকতে হয়।
ফরিদপুর শহরের কয়েকটি মেস ঘুরে দেখা গেছে, এবার তারা ইফতার হিসেবে ছোলা, মুড়ি, বেগুনি, চিনির শরবত খাচ্ছেন। যেখানে কলা রয়েছে সেখানে খেজুর নেই। আবার দু-একটি মেসে একটি খেজুরের সঙ্গে দু-একটি মাত্র আঙুর খাচ্ছেন বাবা-মা ও পরিবার ছেড়ে শহরে লেখাপড়া করতে আসা এসব শিক্ষার্থী।
আরও পড়ুন
শহরের ঝিলটুলি মহল্লার একটি ছাত্রাবাসের সদস্য বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর এলাকার বাসিন্দা এবং ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রমজান সিকদার (২৩)। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদের পরই আমাদের পরীক্ষা। তাই বাধ্য হয়েই এবার রোজায় বাড়িতে না গিয়ে মেসে থাকতে হচ্ছে। এবার ইফতারে যে ছোলা আর মুড়ি পাচ্ছি এই তো অনেক। বাজারে একটা তরমুজের দাম ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে তরমুজ কিনে ভাগ করলে একজনের ভাগে ৯০ থেকে ১০০ টাকা পড়বে। এক তরমুজে এত টাকা খরচ হলে আর অন্য কী খাব!
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, এক মাস আগেও যে খেজুর ২৮০ টাকায় কিনেছি তার দাম এখন ৬০০ টাকার বেশি। আপেল, আঙুর, মাল্টার কথা আর নাইবা বললাম। এভাবে চললে ইফতারে অন্তত ছোলা আর মুড়ির বাইরে কিছু ভাবার সুযোগ নেই।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার বসন্তুপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা ও সরকারি ইয়াছিন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. জনি শেখ (১৮)। তিনি শহরের পূর্ব খাবাসপুরের একটি মেসের সদস্য। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, বাড়ি থেকে টাকা এনে চলতে হয়। যে টাকা আনি এই টাকা দিতেই বাড়ির মানুষের অনেক বেগ পেতে হয়। রমজান উপলক্ষ্যে বেশি টাকা আনার সুযোগ নেই। বাড়ি থেকে আনা সামান্য টাকায় ভালো ফল দিয়ে আমরা ইফতার করতে পারি না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্যই আমাদের ভাজাপোড়া দিয়ে ইফতার করতে হচ্ছে। এতে মাঝেমধ্যেই গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের কোনো আয় নেই। পণ্যদ্রব্যের দাম রমজান মাসে কিছুটা কম থাকলেও আমরা ইফতারে কিছু ভালো খাবার খেতে পারতাম।
মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহরের মেসগুলোতে মিল (খাবার) প্রক্রিয়ায় খাবারের হিসাব রাখা হয়। সকালের খাবারকে আধা মিল, দুপুর ও রাতের খাবারকে পূর্ণ মিল ধরা হয়। সেই হিসাবে তিনবেলা কেউ খেলে তার নামে আড়াই মিল খাবার লেখা হয়। এর সঙ্গে রান্নার বুয়ার বেতনসহ সব মিলিয়ে একেক মিলের দাম পড়ে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত।
রোজার সময়ে ইফতার ও সেহরিকে পূর্ণমিল ও ইফতারের পরে আলু ভর্তা, ভাত বা সবজিকে আধা মিল ধরা হয়। একজন ব্যক্তির একটি ইফতারের মিলে মুড়ি, ছোলা, বেগুনি ও একটি করে খেজুর দিয়েই পূর্ণমিল অর্থাৎ ৫০ টাকার উপরে পড়ে যায়। যেজন্য এসবের বাইরে আরও কিছু করার ভাবনা থাকলেও দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির কারণে তা সম্ভব হয় না।
সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে পড়াশোনা শেষ করে শহরের ঝিলটুলি মহল্লার একটি ছাত্রাবাসে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন মাগুরা সদর উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইব্রাহিম হুসাইন (২৭)। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কী দিয়ে ইফতার করলাম দেখলেনই তো। কোনো ফল নেই। ভাজাপোড়া বানানোর উপকরণ ছোলা, বেসনের দামও গত বছরের থেকে অন্তত ২০/২৫ টাকা বেশি। এই বাস্তবতায় পরিবারের সঙ্গে ইফতার করলে একরকম হত। কিন্তু মেসে ফলের চিন্তা করাটাই বিলাসিতা।
তিনি আরও বলেন, দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতি চলতে থাকলে আমাদের মতো পরিবারের সদস্যদের ডাল-ভাত খেয়েই তো বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।
ওই মেসের বুয়া সাজেদা বেগম (৫৭) ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পোলাপান আগে ভালো-মন্দ বাজার কইরা আনতো। এখন তো বাজার করতেই সমস্যা। যে দাম একটা কিনলে আরেকটা কেনার উপায় থাকে না। সারাদিন রোজা রাইখা যখন ইফতার করতে বসে তখন থালার খাবার দেইখা মন খারাপ হইয়া যায়।’
এমজেইউ