ইব্রাহিম-মোশারফ যেভাবে চায় সেভাবেই চলে সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিস
সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তির যেন শেষ নেই। সেবাপ্রত্যাশীদের অভিযোগ, সকল নিয়ম মেনে পাসপোর্টের আবেদন ফরম জমা দিলেও নানা ধরনের অসঙ্গতি দেখিয়ে ফাইল বাতিল করেন পাসপোর্ট অফিসের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। অথচ দালালদের চাহিদা অনুযায়ী অতিরিক্ত অর্থ দিলে একই ফরম জমা দিয়েই কোনো ভোগান্তি ছাড়া পাসপোর্ট হাতে পাওয়া যায়। তাই সেবাগ্রহীতারা ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে বাধ্য হয়েই দালালচক্রের শরণাপন্ন হন।
শহরের পলাশপোল এলাকার প্রাণসায়ের খাল ধারে অবস্থিত সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। ২০১৪ সাল থেকে নিজস্ব ভবনে এখানে কার্যক্রম শুরু করে অফিসটি। জানা যায়, সাতক্ষীরা আঞ্চলিক অফিসে প্রতিদিন পাসপোর্ট জমা ও সংগ্রহের জন্য ৪০০-৫০০ জন সেবাপ্রত্যাশীর সমাগম ঘটে।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক নিজের পরিচয় গোপন রেখে কয়েক দিন সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যাওয়া-আসা করা সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলেন। সকলেই কোনো না কোনো মাধ্যমে এসেছেন বলে স্বীকার করেন। সাধারণত পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হয়রানি-ভোগান্তি এড়াতে গ্রাহকরা দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করছেন বলে জানান।
আরও পড়ুন
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ থেকে আসা হাসানুর নামের এক ভুক্তভোগী জানান, তিনি অনেক চেষ্টা করেও নিজের পাসপোর্ট করতে পারছিলেন না। তাই বাধ্য হয়ে দালালের সহযোগিতা নিয়ে ৮ হাজার টাকা দিয়ে পাসপোর্ট করেন। মাত্র ১৩ দিনে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন তিনি। ভোগান্তি ছাড়া পাসপোর্ট করতে দালালের বিকল্প নেই।
শুধু হাসানুর নয় সকল সেবাপ্রত্যাশীর বক্তব্য একই। তবে গণমাধ্যমের পরিচয় দিলে পাসপোর্ট না হওয়ার ভয়ে কথা বলতে নারাজ তারা।
ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক পরিচয় গোপন করে গ্রাহক সেজে যান সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে। সেখানে গিয়ে রীতিমতো হতভম্ব হওয়ার মতো ঘটনা চোখে পড়ে। পাসপোর্ট অফিসে প্রবেশ করতেই দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের অস্বাভাবিক আচরণ চোখে পড়ে। গ্রাম থেকে আসা সাধারণ জনগণকে অফিসে প্রবেশ করতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় এখানে। পাসপোর্ট অফিসের পাশে বছরখানেক আগেও কোনো কম্পিউটারের দোকান না থাকলেও সম্প্রতি গড়ে উঠেছে ১০টির মতো দোকান। এই দোকান থেকে পাসপোর্ট ফরম পূরণের পর গ্রাহককে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। দোকানদার মাধ্যম হয়ে দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করান গ্রাহককে। আর দালালকে চাহিদামতো অর্থ দিয়ে ভোগান্তি থেকে রেহাই পান সেবাপ্রত্যাশীরা।
পরিচয় গোপন করে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক মোশারফ হোসেন নামের এক দালালের কাছে যান। প্রতিবেদক কোনো প্রকার ভোগান্তি ছাড়া ১০ বছর মেয়াদের একটি পাসপোর্ট করার কথা বললে মোশারফ হোসেন জানান, ১০ বছর মেয়াদের পাসপোর্ট করতে চাইলে তাকে ৭ হাজার ৭৫০ টাকা দিতে হবে। টাকা দিলে কোনো প্রকার ভোগান্তি ছাড়া অনায়াসে কাজ হয়ে যাবে।
কিছু টাকা কম রাখা যায় কি না জানতে চাইলে মোশারফ বলেন, টাকা কম নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পাসপোর্ট অফিসে খরচ না দিলে কেউ পাসপোর্ট করতে পারবে না। যদি কেউ কম টাকায় করাতে পারে তাহলে তার কাছে যান।
আরও পড়ুন
একইভাবে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ইব্রাহিম নামের আরেক দালালের। চাঞ্চল্যকর সব তথ্য দিলেন তিনি। ১০ বছর মেয়াদের পাসপোর্ট করতে ৭ হাজার ৭৫০ টাকা চাইলেন ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকের কাছে। ঈব্রাহিম বলেন, নির্ধারিত অর্থ দিলে কোনো ঝামেলা ছাড়াই কয়েক দিনের মধ্যে পাসপোর্ট হয়ে যাবে। লাগবে না পুলিশ ভেরিফিকেশনও।
তিনি আরও বলেন, পাসপোর্ট অফিসের আনসার থেকে শুরু করে অফিসার পর্যন্ত সকলেই টাকার ভাগ নিয়ে থাকেন। একজন আনসার সদস্যের বেতন ৯ হাজার ৫০০ টাকা, অথচ পাসপোর্ট অফিসে ট্রান্সফার নিতে ঘুষ দিতে হয়েছে ১০ লাখ টাকা। এত টাকা খরচ করে এখানে এসেছে, তারা তো টাকা আয় করবেই। তাছাড়া পুলিশ এসব বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবে না। কারণ থানাতেও টাকা দিতে হয়। আমরা যে টাকা নিই সেটা সরাসরি অফিস প্রধানসহ সকল স্টাফের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। এখানে লোক (দালাল) ছাড়া কেউ পাসপোর্ট করতে পারবে না।
শুধু মোশারফ কিংবা ইব্রাহিম নয়, এখানকার চারপাশজুড়ে রয়েছে দালাল সিন্ডিকেট চক্র। তাছাড়া প্রতিটি উপজেলায় রয়েছে দালালদের প্রতিনিধি। উপজেলা পর্যায় থেকে গ্রাহক সংগ্রহ করে মূল দালালের কাছে নিয়ে আসেন তারা।
এদিকে দালালদের কাছে রয়েছে পাসপোর্ট তৈরির আলাদা মূল্যতালিকা। দালালের মাধ্যমে ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট করতে গুনতে হবে ৮ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। আবার ১০ বছর মেয়াদে জরুরি পাসপোর্ট করতে দালালকে দিতে হবে ১১ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। যেখানে ১০ বছরের পাসপোর্ট করতে সরকারি ব্যাংক ড্রাফট ফি নির্ধারণ করা ৫ হাজার ৭৫০ টাকা। আর জরুরি পাসপোর্টের সরকারি ফি ৮ হাজার ৫০ টাকা। আবার দালালের মাধ্যমে পাঁচ বছর মেয়াদের পাসপোর্ট করতে দিতে হবে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা, যেখানে সরকারি ফি ৪ হাজার ২৫ টাকা। পাঁচ বছরের জরুরি পাসপোর্ট করতে দালালকে দিতে হবে ৯ হাজার টাকা, যেখানে সরকারি ব্যাংক ড্রাফট নির্ধারণ করা ৬ হাজার ৩৫০ টাকা।
এ ছাড়া টাকা ছাড়া পুলিশ ভেরিফিকেশন হয় না বলেও অভিযোগ করেছেন একাধিক ব্যক্তি। প্রত্যেক পাসপোর্টপ্রত্যাশীকে পুলিশকে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা হলেও দিতে হয়। অনেক সময় এর বেশিও দিতে হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আরও পড়ুন
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক মো. মেহেদী হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা অফিসে যোগদান করেছি। অল্প কয়েক দিনে এখানকার সার্বিক পরিস্থিতি বোঝা সম্ভব নয়। তবে দালাল ও প্রতারক নির্মূলের লক্ষ্যে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে জানিয়েছি। তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন। তাছাড়া আমি যোগদানের পর থেকে অফিসের সকলকে সতর্ক করেছি। এসব কাজে কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সজীব খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে কেউ টাকা নিয়েছে এটার নির্দিষ্ট তথ্য পেলে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মঈনুল ইসলাম মঈন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে। পাসপোর্ট অফিস সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। দালাল ও প্রতারক যারা রয়েছে সকলকে শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আরও পড়ুন
প্রসঙ্গত, সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সেবাপ্রত্যাশীদের হয়রানির বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দুদকের সমন্বিত খুলনা বিভাগীয় কার্যালয় থেকে একটি টিম সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসে অভিযান পরিচালনা করে।
এ বিষয়ে দুদকের খুলনা আঞ্চলিক অফিসের সহকারী পরিচালক ফারদীন খান প্রিন্স ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন সেবাগ্রহীতার অভিযোগের ভিত্তিতে সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসে অভিযান পরিচালনা করা হয়। গ্রাহক সেজে সেখানকার কম্পিউটার দোকানে গেলে এর সত্যতা পাওয়া যায়। গ্রাহক হয়ে কম্পিউটার দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে অফিসের কারও সঙ্গে এদের যোগাযোগ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে।
এমজেইউ