দালালে ভরা দিনাজপুর পাসপোর্ট অফিস, জড়িত আনসাররাও
প্রতিদিনই অনেক মানুষ আসা-যাওয়া করেন দিনাজপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে। এর মধ্যে কেউ আসেন নতুন পাসপোর্টের আবেদন করতে, কেউ আবেদন জমা দিতে, আবার কেউবা আসেন নতুন পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে। তবে যে কেউ পাসপোর্ট অফিসের গেটের সামনে যাওয়া মাত্রই এগিয়ে আসেন কয়েকজন যুবক, জিজ্ঞেস করেন পাসপোর্ট করতে এসেছেন নাকি কাজ সম্পন্ন হয়েছে? এরপর নতুন পাসপোর্ট করতে আসা ব্যক্তি পেয়ে গেলেই হাতে ধরিয়ে দেন একটি ভিজিটিং কার্ড। আর সরাসরি পাসপোর্টের আবেদনের নানা ঝামেলার কথা বুঝিয়ে পাসপোর্টের আবেদনের ফি’র বাইরে অফিস খরচ বাবদ কারও কাছে অতিরিক্ত ১ হাজার ৫০০ আবার কারও কাছে ১ হাজার ৩০০ টাকা নেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরা অনিয়মের মাধ্যমে পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়া চক্রের সদস্য। দিনাজপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে রয়েছে এই চক্রের বহু সদস্য। এই চক্রের সদস্যরা পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে কাজ করে দেন। এ ছাড়া এই চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে সেখানকার নিরাপত্তার দ্বায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরাও।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক দিনাজপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দুই সপ্তাহ ধরে যাওয়া-আসা করা সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের কেউ কেউ চক্রের মাধ্যমে সহজে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। আবার কেউ কেউ আবেদন করে ঘুরেছেন মাসের পর মাস। তবে অনলাইনে সব ধরনের সেবাগ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ করার ফলে আগের চেয়ে ভোগান্তি, উৎকোচ প্রদানের হার ও বিড়ম্বনা কিছুটা কমে এসেছে বলে কেউ কেউ জানিয়েছেন।
দিনাজপুর জেলা সদরের মিশন রোডে এলজিইডি অফিসের বিপরীতে অবস্থিত দিনাজপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন ভবনে এই অফিসের কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বরের একটি ভবনের কয়েকটি রুমে চলতো পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম। তখন থেকেই পাসপোর্ট অফিসের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। সম্প্রতি গিয়েও পাসপোর্ট অফিসে কোনো শৃঙ্খলা চোখে পড়েনি। যে যার মতো ছোটাছুটি করছে অফিসজুড়ে। আর পাসপোর্ট প্রত্যাশী মানুষের চাপ বেশি থাকার সুযোগ নিচ্ছে দালালরা।
দিনাজপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসকে কেন্দ্র করে অফিসের পাশে গড়ে উঠেছে অন্তত ২০টি কম্পিউটার দোকান। অথচ পাসপোর্ট অফিস হওয়ার আগে এখানে একটি মুদি ও একটি খাবারের হোটেল ছাড়া কোনো দোকানই ছিল না। এসব কম্পিউটার দোকানকে কেন্দ্র করে একটি দালাল সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন
পরিচয় গোপন রেখে পাসপোর্ট অফিসে প্রবেশের সময় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইমন ইসলাম নামের এক যুবক ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদককে জিজ্ঞেস করেন, পাসপোর্ট করতে এসেছেন নাকি কাজ সম্পন্ন হয়েছে? পরে এ প্রতিবেদক নতুন পাসপোর্ট করতে কী কী লাগবে জানতে চাইলে হাতে পাপ্পু কম্পিউটার নামের একটি দোকানের ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলেন, আপনি পাসপোর্টের সরকারি ফি দেবেন, আর আমাদের অফিসের খরচ বাবদ ১ হাজার ৩০০ টাকা দিলে আপনাকে কিছু করতে হবে না। সব কাজ আমরাই করে দেব। আপনার কাছে যদি জাতীয় পরিচয়পত্র থাকে তাহলে এখনই আমাদের দোকানে গিয়ে আবেদন করেন। সেখানে আমার বড় ভাই আশিক আছে।
এরপর ওই যুবকের কথামতো ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদক আবেদনের জন্য পাপ্পু কম্পিউটারের দোকানে গেলে সেখানে থাকা আশিক এগিয়ে আসেন এবং নিজে আবেদন করলে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে বলে জানান। পরে আশিক এই প্রতিবেদককে বলেন, আপনি আমাদের থেকে আবেদন করেন, কোনো প্যারা নিতে হবে না। এখানে আবেদন করলে সব দায়-দায়িত্ব আমাদের। শুধু আমাদের খরচ বাবদ ১ হাজার ৫০০ টাকা দিলেই চলবে।
সেই দোকান থেকে অফিসে প্রবেশ করার সময় সেখানকার নিরাপত্তার দ্বায়িত্বে থাকা আইনুল ইসলাম নামের এক আনসার সদস্য ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদককে জিজ্ঞেস করেন কী কাজে ভেতরে যাবেন? কথা বলার একপর্যায়ে নতুন পাসপোর্ট করার বিষয় জানতে পেরে নিজ আগ্রহ থেকে বলেন, কোনো ঝামেলা ছাড়াই কাজ হবে যদি আপনি আমার মাধ্যমে কাজ করে নেন। আপনি যদি ১০ বছর মেয়াদি ৪৮ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট করেন তাহলে আমাকে ৮ হাজার টাকা দিতে হবে। অথচ সরকারি ফি অনুযায়ী ৪৮ পৃষ্ঠার ১০ বছর মেয়াদি নিয়মিত পাসপোর্ট করতে প্রয়োজন ৫ হাজার ৭৫০ টাকা।
পরে ঢাকা পোস্টের পরিচয় দিয়ে ওই আনসার সদস্যের কাছে অতিরিক্ত টাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করা শুরু করেন এবং নানাভাবে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কম্পিউটার দোকানের অপারেটর ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই দালাল সিন্ডিকেটদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালকসহ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গোপন আঁতাত রয়েছে। দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সুকৌশলে আদায় করা হয় অতিরিক্ত টাকা। প্রতিদিন গড়ে ১৫০-১৬০টি আবেদন জমা হয় পাসপোর্ট অফিসে। এ আবেদনগুলো দোকান থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে করতে হয়। আবেদনের সময় দোকান মালিক ও দালালরা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আবেদনকারীদের কাছ থেকে ব্যাংকের নির্ধারিত ফি ছাড়াও অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন।
পাসপোর্ট অফিসের সিটিজেন চার্টারের তথ্য অনুযায়ী, ৪৮ পৃষ্ঠার এবং পাঁচ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৪ হাজার ২৫ টাকা (বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫% ভ্যাটসহ) ফি জমা দিতে হবে। এই পাসপোর্ট পেতে ১৫ থেকে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হবে। আর জরুরি পাসপোর্ট করতে লাগবে ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, আর এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৭ থেকে ১০ দিন। অন্যদিকে ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে অতীব জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এ ছাড়া ৪৮ পৃষ্ঠার এবং ১০ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা লাগবে। এই পাসপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৫ থেকে ২১ দিন। আর ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে ফি দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এর বাইরে অতীব জরুরি পাসপোর্ট ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে নিতে চাইলে শুধু ফিই গুনতে হবে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, ঝামেলা এড়াতে বাধ্য হয়েই দালালদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পাসপোর্টের কাজ করিয়ে নিচ্ছেন তারা।
পার্বতীপুর উপজেলা থেকে ছেলে কাইয়ুমের নতুন পাসপোর্ট করাতে এসেছেন নাজমুল মিয়া। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা তো এত কিছু বুঝি না। ঝামেলায় না গিয়ে লোক ডাকছিল, দোকানে গেছি তারপর সাড়ে ৭ হাজার দিছিলাম। আবেদন করে জমা দিছি কয়েক দিন হলো। আজকে ছেলেসহ আসছি পাসপোর্ট নেওয়ার জন্য, কিন্তু পাইলাম না।’
আরও পড়ুন
খানসামা উপজেলার বোডের হাট বাজারের শিক্ষার্থী মাসুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করার জন্য অনলাইনে আবেদন করি। আবেদনের কপি নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে প্রায় ৫ হাজার ৬০০ টাকা জমা দিয়ে দিনাজপুর পাসপোর্ট অফিসে গিয়েছিলাম ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার জন্য। কিন্তু কিছুটা ভুল থাকায় আমার আবেদন বাতিল করে দেন এবং তখনই অফিসের একজন কর্মকর্তা এক দালালকে দিয়ে বলেন উনার কাজটা করে দাও।
তিনি আরও বলেন, ‘পরে এক হাজার ৫০০ টাকা দিছি, এক ঘণ্টার মধ্যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে চলে আসছি। এসব ঝামেলা না করে দুই-এক হাজার টাকা নিছে ভালো হইছে। পরে পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় বলে আমার বাবার ভোটার আইডির সঙ্গে মিল নেই। কী করতে হবে জানতে চাইলে পুলিশ সদস্য বলেন, ১ হাজার ৫০০ টাকা দাও আমি ঠিক করে দিচ্ছি। পরে আমি এক হাজার টাকা দিছি, কাজ হয়ে গেছে।’
চিরিরবন্দর উপজেলার আব্দুলপুর গ্রামের আতিকুর ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি আমার স্ত্রী ও শ্বশুর-শাশুড়িসহ চিকিৎসার জন্য ভারতে যাব। এজন্য অনলাইনে চারজনের নামে পাসপোর্টের আবেদন করে ব্যাংকে গিয়ে টাকা জমা করি। আমার সবকিছু ঠিক থাকার পরও পুলিশ ভেরিফিকেশনে নাস্তার টাকা চায়। আমি দিতে রাজি না হওয়ায় আমার রিপোর্ট জমা দেয়নি। পরে নাস্তার জন্য তিন হাজার টাকা চাইলে আমি পুলিশকে দুই হাজার টাকা দিই। আসলে টাকা ছাড়া আমাদের দেশে সরকারি সেবা পাওয়া মুশকিল হয়েছে পড়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) দিনাজপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক লোকমান হাকিম রুবেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসে দালালরা সেখানকার আনসারদের মাধ্যমে একটা সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। এজন্য সাধারণ জনগণ পাসপোর্ট করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে। আমি মনে করি পাসপোর্ট অফিসে লোকবল বাড়ানো প্রয়োজন। আর যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে তৃতীয় পক্ষের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে এ সেবা নিশ্চিত করা উচিত।
সকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে দিনাজপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক আজিজুল হক খানের রুমে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার সহকারী ফোন রিসিভ করে বলেন, স্যারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে আগামী কর্মদিবসে আসেন।
এরপর অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক জামিল রায়হান বিন ইসলামের কক্ষে গেলে তিনি ক্যামেরা দেখে তা বন্ধ করতে বলেন এবং সাংবাদিক কি না জানতে চান। পরে পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে দালালদের আনাগোনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
পাসপোর্টের আবেদন ফরমসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাসপোর্ট অফিসে জমা দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই সাধারণত পুলিশ ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হয়। অভিযোগ রয়েছে ভেরিফিকেশনের নামে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা পাসপোর্ট প্রতি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে টাকা ছাড়া পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছে এমন নজিরও রয়েছে।
পুলিশ ভেরিফিকেশনে টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দিনাজপুর পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এ বিষয়ে অবগত ছিলাম না। আপনি জানালেন, এখন আমি বিষয়টি দেখব।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দেবাশীষ চৌধুরীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এ বিষয়ে অবগত ছিলাম না। আপনি জানালেন, আমরা খুব তাড়াতাড়ি সেখানে অভিযান পরিচালনা করবো।
এমজেইউ