নীলফামারী পাসপোর্ট অফিস দালাল শিকদারদের দখলে
নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার কৈমারী এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম। গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। তবে পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে এসেছেন নীলফামারী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে। তিনি অফিসে এসে বিভিন্নজনের কাছে পাসপোর্টের আবেদনের বিষয়ে জানতে চান। এ সময় সিয়াম শিকদার নামের এক যুবক তাকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেন। তিনি পাসপোর্টের আবেদনের নানা ঝামেলার কথা বুঝিয়ে শফিকুলের কাছে পাসপোর্টের আবেদনের ফি’র বাইরে অফিস খরচ বাবদ ১ হাজার ৫০০ টাকার কথা বলেন। এরপর ওই যুবক কৌশলে শফিকুলকে পাঠিয়ে দেন অফিসের পাশে তার কম্পিউটারের দোকানে। আর এভাবেই পাসপোর্ট অফিসে সাহায্যের নামে দালালদের ফাঁদে পড়েন সাধারণ মানুষ।
শুধু শফিকুল নয়, পাসপোর্ট অফিসে নতুন কাউকে দেখলেই এগিয়ে যান সিয়ামের মতো কয়েকজন। এরপর কথাবার্তার মারপ্যাঁচে কেউ জালে আটকা পড়ে তাদের হাত ধরে পাসপোর্ট করেন আর কেউ পরিস্থিতি বুঝে কেটে পড়েন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিয়াম সিকদার অনিয়মের মাধ্যমে পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়া চক্রের সদস্য। নীলফামারী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে রয়েছে এই চক্রের বহু সদস্য। এই চক্রের সদস্যরা পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে কাজ করে দেন।
শফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি অফিস থেকে দুই দিনের ছুটি নিয়ে পাসপোর্ট করতে এসেছি। সরাসরি পাসপোর্টের আবেদন করতে নানা ধরনের ভোগান্তির কথা শুনে ওই লোকের মাধ্যমে ১ হাজার ৫০০ টাকা বেশি দিয়ে আবেদন করলাম। আমি তো এসব বিষয়ে কম বুঝি। এজন্য বেশি ঝামেলায় না গিয়ে কিছু টাকা বেশি দিলাম, যাতে করে কোনো ভুল বের না হয়।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক নীলফামারী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে এক সপ্তাহ ধরে যাওয়া-আসা করা সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের কেউ কেউ চক্রের মাধ্যমে সহজে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। আবার কেউ কেউ আবেদন করে ঘুরেছেন মাসের পর মাস। তবে অনলাইনে সব ধরনের সেবাগ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ করার ফলে আগের চেয়ে ভোগান্তি, উৎকোচ প্রদানের হার ও বিড়ম্বনা কিছুটা কমে এসেছে বলে কেউ কেউ জানিয়েছেন।
নীলফামারী জেলা সদরের কুখাপাড়া চেতাশাহর ঘুন্টি এলাকায় অবস্থান নীলফামারী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের। গত বছরের শেষ দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন ভবনে এই অফিসের কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে জেলা শহরের জেলখানা সড়কের পাশে একটি ভাড়া বাসায় চলতো পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম। তখন থেকেই পাসপোর্ট অফিসের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। সম্প্রতি গিয়েও পাসপোর্ট অফিসে কোনো শৃঙ্খলা চোখে পড়েনি। যে যার মতো ছোটাছুটি করছে অফিসজুড়ে। আর পাসপোর্ট প্রত্যাশী মানুষের চাপ বেশি থাকার সুযোগ নিচ্ছে দালালরা।
শুধু নীলফামারী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসকে কেন্দ্র করে অফিসের পাশে গড়ে উঠেছে অন্তত ১৫টি কম্পিউটার দোকান। অথচ পাসপোর্ট অফিস হওয়ার পূর্বে এখানে কোনো ধরনের দোকানই ছিল না। এসব কম্পিউটার দোকানকে কেন্দ্র করে একটি দালাল সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।
পরিচয় গোপন রেখে ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক নতুন পাসপোর্ট করতে কী কী লাগবে, এমন তথ্য জানতে চাইলে পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত সদস্যরা তথ্য দিতে বিলম্ব করেন। এরই মধ্যে অপরিচিত একজন এসে জানতে চান পাসপোর্ট করবো কি না। এরপর তিনি হুসাইন হুমায়রা অনলাইন সেন্টার নামের একটি দোকানের ভিজিটিং কার্ড হাতে ধরিয়ে দেন। তারপর ওই ব্যক্তি নিজে থেকে বলতে থাকেন, সময় নষ্ট না করে বাইরে আমাদের কম্পিউটারের দোকানে যান, সেখানে আমাদের লোক আপনার সব কাজ করে দেবে। শুধু খরচ বাবদ ১ হাজার ৫০০ টাকা বেশি দিলেই চলবে। আর এখানে নিজে থেকে আবেদন করলে আপনার আবেদনে সঠিক থাকলেও ভুল বের হবে। আর পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য পুলিশকেও চা খাওয়াতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কম্পিউটার দোকানের অপারেটর ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই দালাল সিন্ডিকেটদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালকসহ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গোপন আঁতাত রয়েছে। দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সুকৌশলে আদায় করা হয় অতিরিক্ত টাকা। জেলা থেকে প্রতিদিন গড়ে ৮০-৯০টি পাসপোর্ট আবেদন জমা হয় পাসপোর্ট অফিসে। এ আবেদনগুলো দোকান থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে করতে হয়। আবেদনের সময় দোকান মালিক ও দালালরা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আবেদনকারীদের কাছ থেকে ব্যাংকের নির্ধারিত ফি ছাড়াও অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন।
পাসপোর্ট অফিসের সিটিজেন চার্টারের তথ্য অনুযায়ী, ৪৮ পৃষ্ঠার এবং পাঁচ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৪ হাজার ২৫ টাকা (বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫% ভ্যাটসহ) ফি জমা দিতে হবে। এই পাসপোর্ট পেতে ১৫ থেকে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হবে। আর জরুরি পাসপোর্ট করতে লাগবে ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, আর এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৭ থেকে ১০ দিন। অন্যদিকে ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে অতীব জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এ ছাড়া ৪৮ পৃষ্ঠার এবং দশ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা লাগবে। এই পাসপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৫ থেকে ২১ দিন। আর ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে ফি দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এর বাইরে অতীব জরুরি পাসপোর্ট ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে নিতে চাইলে শুধু ফিই গুনতে হবে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, ঝামেলা এড়াতে বাধ্য হয়েই দালালদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পাসপোর্টের কাজ করিয়ে নিচ্ছেন তারা।
জেলা শহরের কালীতলা থেকে নাতনির পাসপোর্ট করতে এসেছেন আতিকুল ইসলাম আতিক। ১০ বছর মেয়াদি ৪৮ পৃষ্ঠার জরুরি পাসপোর্টের জন্য তিনি দালালকে দিয়েছেন সাড়ে ১১ হাজার টাকা। অথচ ১০ বছর মেয়াদি ৪৮ পৃষ্ঠার জরুরি পাসপোর্টের ফি ৮ হাজার ৫০ টাকা। আতিকুল ইসলাম জানান ঝামেলা এড়াতেই দালালকে বাড়তি টাকা দিয়েছেন।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে পাসপোর্ট অফিসটা আমাদের দিকে ছিল। সেখানকার এক ছেলের মাধ্যমে পাসপোর্টের কাজ করাচ্ছি। তবে কিছু টাকা বেশি লাগতেছে। কিন্তু কী করার আছে। আমরা কাজ করলে হয়ত ভুল হতে পারে। এজন্য টাকা যাক তবুও যেন ভোগান্তি না হয়। আমারও পাসপোর্ট করা আছে তবে মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আমিও পাসপোর্ট রিনিউ করবো।
ডোমার থেকে আসা রাশেদ ইসলাম নামের এক যুবক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার সবই ঠিক ছিল তারপরও আমি বেশ কিছুদিন ঘুরেছি। এরপর অফিসের একজন আমার কাছ থেকে ১ হাজার টাকা নিয়েছে। তারপরও কয়েক দিন ঘুরলাম সার্ভার সমস্যার কারণে।
জেলা সদরের বাবরীঝাড় এলাকার মো. মনির ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট করার জন্য রেলঘুন্টি এলাকার দৃষ্টি কম্পিউটারের মোজাহিদের কাছে সাড়ে ৮ হাজার টাকা দিয়েছি। আমি ঢাকায় চাকরি করি। এলাকায় এসেছিলাম পাসপোর্ট করার জন্য, যাতে তাড়াতাড়ি পাসপোর্টটি হাতে পাই। সেজন্য দালালকে বাড়তি টাকাও দিয়েছি। কিন্তু তারা নাকি বিকাশের মাধ্যমে ব্যাংক ড্রাফট করেছে, আমার টাকা দেওয়ার মেসেজ আসেনি। তাই আমাকে এক থেকে দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে বলেছিল। পরে চাকরির চাপে আমি আর অপেক্ষা করতে পারিনি। এভাবে দুই মাস কেটে গেল, এখনও আমার কাজ হয়নি।
নীলফামারী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সিনিয়র সাংবাদিক তাহমিন হক ববি ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনগণের জন্য সরকার পাসপোর্টের সকল কাজ অনলাইনের মাধ্যমে করার ব্যবস্থা করেছে। এই সুবিধা অনলাইনের মাধ্যমে জনগণ পাচ্ছে কিন্তু যখন ছবি তুলতে যাচ্ছে তখন দালালের খপ্পরে পড়ছে। দালালকে পাশ কাটিয়ে গেলেও তখন অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা হয়রানি করছে। এগুলোর নিয়মিত মনিটরিং বা তদারকি করা খুবই জরুরি। কেননা দেশের পাসপোর্ট অফিসগুলো স্বচ্ছতার আওতায় আনা খুব প্রয়োজন।
সকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে নীলফামারী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ সাইফুল হাসানের রুমে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছুটিতে আছি, পরে অফিসে আসিয়েন কথা হবে।
দালালদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে একাধিকবার প্রশ্ন করা হলে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তিনি কল কেটে দেন।
পাসপোর্টের আবেদন ফরমসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাসপোর্ট অফিসে জমা দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই সাধারণত পুলিশ ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হয়। অভিযোগ রয়েছে ভেরিফিকেশনের নামে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা পাসপোর্ট প্রতি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে টাকা ছাড়াও পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছে এমন নজিরও রয়েছে।
পুলিশ ভেরিফিকেশনে টাকা নেওয়ার বিষয়ে নীলফামারী জেলা পুলিশের দায়িত্বরত কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পুলিশ সুপারের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সব অভিযোগের বিষয়ে নীলফামারীর জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট অফিস একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এখানে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এসব বিষয় জানা ছিল না। যদি এরকম কিছু হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এমজেইউ