গাইবান্ধায় দালাল ছাড়া পাসপোর্টের আবেদন জমা দেওয়া যায় না
গাইবান্ধা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দালাল ব্যতীত সেবা পাওয়া অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। ভুক্তভোগী সেবাপ্রার্থীরা বলছেন, নিজেরা পাসপোর্টের আবেদন করলে অহেতুক নানা কারণ দেখিয়ে হয়রানি করা হয়। তবে কোনো দালালের শরণাপন্ন হয়ে অতিরিক্ত টাকা দিলেই নিমিষেই শেষ হয়ে যায় পাসপোর্টের সব কাজ।
অভিযোগ রয়েছে, এই অফিসের দায়িত্বরত আনসার সদস্যরাও কখনো কখনো দালালের ভূমিকা নিয়ে থাকেন। শুধু তাই নয়, পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে আসা ব্যক্তিদের কাছ থেকে চা খাওয়ার কথা বলে টাকা চেয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে এই আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে। তবে সচেতন হয়ে দালাল চক্রের ফাঁদে না পড়ে দুই-তিন দিন ঘুরে অতিরিক্ত টাকা ছাড়াই পাসপোর্ট পাওয়ার নজিরও রয়েছে এখানে। তবে বেশির ভাগ সেবাপ্রার্থীরাই ভোগান্তি এড়াতে দালাল চক্রের শরণাপন্ন হয়ে পাসপোর্ট করে থাকেন। এ অবস্থায় দালালের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বারবার আশ্বাস দিলেও বদলায়নি চিত্র।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী আঞ্চলিক সড়কের তিন মাইল এলাকায় অবস্থান গাইবান্ধা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের। গত বছরের শেষ দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন ভবনে এই অফিসের কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পশ্চিম পার্শ্বের দুটি রুমে অস্থায়ীভাবে চলত পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম। তখন থেকেই পাসপোর্ট অফিসের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।
সরেজমিনে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক গাইবান্ধা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে চার দিন যাওয়া-আসা করে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছেন। এদের মধ্যে সিংহভাগ ভুক্তভোগী দালালের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। আবার দু-একজন কয়েক দিন দিন ঘুরে কোনো উৎকোচ ছাড়াই পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন।
এক পাসপোর্ট অফিসকে কেন্দ্র করে ২৬টি কম্পিউটার দোকান
শুধু গাইবান্ধা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসকে কেন্দ্র করে রাস্তার দুপাশে গড়ে উঠেছে অন্তত ২৬টি কম্পিউটার দোকান। অথচ পাসপোর্ট অফিস হওয়ার পূর্বে এখানে কয়েকটি মুদির দোকান ছাড়া কোনো কম্পিউটার দোকান ছিল না। এসব কম্পিউটার দোকানকে কেন্দ্র করে কম্পিউটার মালিকদের নিয়ে একটি দালাল সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কম্পিউটার দোকানের অপারেটর ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই দালাল সিন্ডিকেটদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালকসহ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গোপন আঁতাত রয়েছে। দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সুকৌশলে আদায় করা হয় অতিরিক্ত টাকা। জেলা থেকে প্রতিদিন গড়ে ৭০-৭৫টি পাসপোর্ট আবেদন জমা হয় পাসপোর্ট অফিসে। এ আবেদনগুলো কম্পিউটারের মাধ্যমে দোকান থেকে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। আবেদনের সময় দোকান মালিক ও দালালরা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আবেদনকারীদের কাছ থেকে ব্যাংকের নির্ধারিত ফি ছাড়াও অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন।
গোবিন্দগঞ্জ থেকে আসা রায়হান নামের এক ভুক্তভোগী যুবক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি গাইবান্ধা পাসপোর্ট অফিসের সামনে এসে একটি দোকানে দুই শ টাকা দিয়ে অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন ফরম পূরণ করি। এরপর প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ পাসপোর্ট অফিসে জমা দিতে গেলে তারা জাতীয় পরিচয়পত্রের মূল কপিসহ জেলা নির্বাচন অফিসের একটি সার্টিফায়েড কপি চায়। এরপর আবার ওই দোকানে গেলে তারা আমাকে পরামর্শ দেয় আপনার কিছুই লাগবে না যদি অতিরিক্ত কিছু টাকা খরচ করেন তাহলে আজই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। পরে তাদের পরামর্শে অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা খরচ করে কাগজপত্র জমা দিয়ে সেদিনই ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিই।
উপজেলা থেকে আসা মানুষদের টার্গেট করেন দালালরা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ২৬টি কম্পিউটার দোকানসহ পাসপোর্ট অফিসের আশপাশে ভ্রাম্যমাণ দালালের সংখ্যা অন্তত অর্ধশতাধিক। এসব দালালদের প্রথম টার্গেটে থাকে সদর উপজেলা ব্যতীত বাকি ছয় উপজেলার মানুষ। লুঙ্গি পড়া কিংবা সাদাসিধে স্বভাবের কোনো মানুষ দেখলেই দালালরা বলে থাকেন ‘পাসপোর্ট করবেন? চলেন আমি সাহায্য করি।’ আর এভাবেই সাহায্যের নামে দালালদের ফাঁদে পড়েন সাধারণ মানুষ। তবে সচেতন মানুষরা এদের পাত্তা দেন না।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা মুরাদ হোসেন নামের এক ভুক্তভোগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত দেড় মাস আগে বিদেশ যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করতে আসি গাইবান্ধায়। এসেই সাহায্য করার নামে একজন লোক একটি দোকানে নিয়ে গিয়ে অনলাইনে ফরম পূরণ করে দেন। সেই ফরম পূরণের জন্য আমি ২০০ টাকা দিই। পরে ওই ব্যক্তি আমাকে বলেন ‘আপনি একা পাসপোর্ট করতে গেলে আপনাকে দুই-তিন দিন ঘুরতে হবে, আর আমাদের মাধ্যমে করলে আপনি আজকেই ফিঙ্গারপ্রিন্টসহ যাবতীয় কাজ শেষ করে বাড়ি যেতে পারবেন। সুন্দরগঞ্জ থেকে গাইবান্ধার দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় অনেক চিন্তাভাবনা করে যেখানে ১০ বছর মেয়াদি সাধারণ পাসপোর্টে অফিসিয়াল ফি ৫ হাজার ৭৫০ টাকা আমি প্রায় নয় হাজার টাকা দিই।
সিটিজেন চার্টার শুধু আইওয়াশ
পাসপোর্ট অফিসের সিটিজেন চার্টারের তথ্য অনুযায়ী, ৪৮ পৃষ্ঠার এবং পাঁচ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৪ হাজার ২৫ টাকা (বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫% ভ্যাটসহ) ফি জমা দিতে হবে। এই পাসপোর্ট পেতে ১৫ থেকে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হবে। আর জরুরি পাসপোর্ট করতে লাগবে ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, আর এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৭ থেকে ১০ দিন। অন্যদিকে ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে অতীব জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এ ছাড়া ৪৮ পৃষ্ঠার এবং দশ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা লাগবে। এই পাসপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৫ থেকে ২১ দিন। আর ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে ফি দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এর বাইরে অতীব জরুরি পাসপোর্ট ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে নিতে চাইলে শুধু ফিই গুনতে হবে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দালাল চক্রের এক সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই অফিসে টাকা ছাড়া পাসপোর্ট হয় না এ কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। অতিরিক্ত টাকা ছাড়াও পাসপোর্ট হয়, কিন্তু আপনাকে দুই-তিন দিন ঘুরতে হবে। বিশেষ করে উপজেলার লোকজনের পক্ষে পাসপোর্ট অফিসে দুই-তিন দিন আসা সম্ভব হয় না। তাই ভোগান্তি এড়াতে তারা দালালের শরণাপন্ন হন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের মাধ্যমে পাসপোর্ট করলে অফিসে মিনিমাম আমাদেরকে ১ হাজার টাকা দিতে হয়। ১০ বছর মেয়াদি ৪৮ পৃষ্ঠার সাধারণ পাসপোর্টের ফি ৫ হাজার ৭৫০ টাকা। এই কাজটি দালালের মাধ্যমে করলে সর্বনিম্ন এর প্যাকেজ সাড়ে সাত হাজার থেকে আট হাজার টাকা লাগে। এ ছাড়া প্যাকেজভেদে সরকারি ফি ছাড়াও অতিরিক্ত আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা দিলেই অনায়াসে কোনো ভোগান্তি ছাড়াই পাসপোর্ট করা যায়।
পুলিশ ভেরিফিকেশনে সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা
পাসপোর্টের আবেদন ফরমসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাসপোর্ট অফিসে জমা দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই সাধারণত পুলিশ ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হয়। অভিযোগ রয়েছে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা পাসপোর্ট প্রতি ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা নিয়ে থাকেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে টাকা ছাড়াও পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছে এমন নজিরও রয়েছে।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার রওশনআরা নামের এক ভুক্তভোগী এনজিওকর্মী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য আমিসহ দুইজনের পাসপোর্টের আবেদন করে কাগজপত্র জমা দিই। এক সপ্তাহের মধ্যে এক পুলিশ কর্মকর্তা ভেরিফিকেশনের জন্য ফোন দেন। পরে সকল কাগজপত্র দেখে উৎকোচ হিসেবে আমরা তাকে ২ হাজার টাকা দিই।
পুলিশ ভেরিফিকেশনে টাকা নেওয়ার বিষয়ে গাইবান্ধা জেলা পুলিশের দায়িত্বরত কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গাইবান্ধা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে গিয়ে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করে মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় পুলিশ সুপারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের ডিএসবি (ডিটেকটিভ স্পেশাল ব্রাঞ্চ) শাখার এক পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, আগের চেয়ে মানুষ এখন সচেতন হয়েছে। কোনটা ফি আর কোনটা উৎকোচ এখন মানুষ বোঝে। তবে এখনো কিছু মানুষের ধারণা আছে টাকা ছাড়া কাজ হয় না। তারাই সাধারণত এই ধরনের ভুল করে থাকে।
কী বলছেন পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক
সকল অভিযোগ নিয়ে সরাসরি কথা বলতে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক দেখা করেন গাইবান্ধা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক সরবেশ আলীর সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এই পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে কোনো দালাল নেই, বাইরে যে কী অবস্থা তা আমি বলতে পারব না। আমাদের এখানে প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৭০টি আবেদন জমা পড়ে। আগে প্রতি মঙ্গলবার গণশুনানি করা হত কিন্তু বর্তমানে যখন যে সমস্যা সেটি সঙ্গেই সঙ্গেই সমাধান করে দেওয়া হয়। যার কারণে এখন আর নির্ধারিত দিন ঠিক করে কোনো শুনানির প্রয়োজন পড়ে না।
তিনি আরও বলেন, অতিরিক্ত টাকা নিয়ে পাসপোর্ট করার কোনো সুযোগ নেই। এখানে সেবাপ্রত্যাশীরা নিজে এসে আবেদন জমা দিয়ে যান। নিয়ম অনুযায়ী এখানে পাসপোর্ট হয়। সুতরাং টাকা নেওয়ার কোনো অভিযোগ সত্য নয়।
কী বলছেন জেলা প্রশাসক
সকল অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুলের সঙ্গে। তিনি মুঠোফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট অফিস একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এখানে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে পাসপোর্ট করার কোনো সুযোগ নেই। যদি এই ধরনের কোনো অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ মিলে তাহলে অবশ্যই যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমজেইউ