জয়পুরহাটে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগে পাঁচ পদে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত
ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার জামুহালী চশমায়ে উলুম দ্বি-মুখী আলিম মাদরাসায় নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) মাদরাসা উপাধ্যক্ষসহ পাঁচটি শূন্য পদে নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিয়োগের জন্য ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ তোলেন স্থানীয় ইউপি সদস্য রুহুল আমিন। পরে শুক্রবার সকালে অনিবার্য কারণ দেখিয়ে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
শুক্রবার সকালে নির্ধারিত সময়ে প্রার্থীরা পরীক্ষা দিতে মাদরাসায় আসেন। এসে তারা মাদরাসার মূল ফটকে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিতের নোটিশ দেখতে পান। এ সময় মাদরাসায় শুধু একজন নিরাপত্তা কর্মী ছাড়া শিক্ষক-কর্মচারীরা কেউই ছিলেন না। পরীক্ষার্থীরা প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর ফিরে গেছেন।
এসময় বড়তারা গ্রামের আরিফুর রহমান বলেন, আমি অফিস সহকারী পদে আবেদন করেছি। সকাল ১০ টায় নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। মাদরাসার ফটকে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিতের নোটিশ দেওয়া আছে। অনেকেই অপেক্ষা করে বাড়িতে ফিরে গেছে। আমিও চলে যাচ্ছি।
ওই মাদরাসায় গিয়ে দেখা গেছে, মাদরাসার মূল ফটক বন্ধ রয়েছে। মূল ফটকে একটি নোটিশ টানানো রয়েছে। সেখানে মাদরাসার অধ্যক্ষের স্বাক্ষর রয়েছে। ওই নোটিশে বলা হয়েছে, ‘এতদ্বারা জামুহালী চশমায়ে উলুম দ্বিমুখী আলিম মাদরাসার উপাধ্যক্ষ, অফিস সহকারী কাম-হিসাব সহকারী, অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও আয়া পদে নিয়োগ পরীক্ষা অদ্যই ১৬/০২/২০২৪ ইং তারিখে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনিবার্য কারণবশত নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হলো। সাক্ষাৎকার বোর্ডের তারিখ পরবর্তী সময়ে জানানো হবে।’
মাদরাসা নিরাপত্তা কর্মী মামুনুর রশিদ বলেন, মাদরাসা পাঁচটি পদে নিয়োগ পরীক্ষা সকাল ১০টায় শুরু হওয়ার কথা ছিল। অধ্যক্ষ স্যার মাদরাসায় আসেননি। তিনি সকাল ৯টার একটু আগে আমাকে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিতের নোটিশ পাঠিয়েছেন। আমি মাদরাসার মূল ফটকে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিতের নোটিশ টানিয়ে দিয়েছি। পাঁচটি পদের পরীক্ষার্থীরা মাদরাসায় এসে অপেক্ষা করে চলে গেছেন। আমি ছাড়া অন্য শিক্ষক কর্মচারীরা মাদরাসায় আসেননি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য রুহুল আমিন বলেন, আমার ওর্য়াডের জামুহালী চশমায়ে উলুম দ্বিমুখী আলিম মাদরাসায় উপাধ্যক্ষসহ পাঁচটি পদে লোক নিয়োগ হওয়ার কথা। এই নিয়োগ গিয়ে মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি বোরহান উদ্দিন ও মাদরাসার অধ্যক্ষ আবু নাছের রেজাউল করিম অনেকের কাছে টাকা চেয়েছে। আবার কারও কাছ থেকে তারা টাকা নিয়েছেও। অনেক প্রার্থীদের কাছ থেকে ২ লাখ থেকে ৪ লাখ করে তারা টাকা নিয়েছে। তারা আনুমানিক ৬০ লাখ থেকে ৭০ লাখ টাকা চুক্তি করেছে বলে জানতে পেরেছি।
তিনি বলেন, শুক্রবার মাদরাসার সভাপতি ও অধ্যক্ষসহ ওই কমিটির কয়েকজন মিলে পাতানো নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। ঘটনাটি জানার পর নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল চেয়ে আমার ফেসবুকে অ্যাকাউন্টে পোস্ট দিয়েছিলাম। পাশাপাশি ঘটনাটি স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ সরকারি কর্মকর্তাদের জানিয়েছিলাম। এরপর নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। তার চাওয়া এখানে মেধাবী, অসহায় যারা চাকরি পাচ্ছে না। সেই লোকদের এই মাদরাসায় চাকরি হোক। কিন্তু দুর্নীতি কেন হচ্ছে?
জামুহালী গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল করিম বলেন, আমার ছেলে ফেরদাউস অফিস সহকারী পদে আবেদন করেছেন। মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি বড়তারা ইউপি চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিনকে প্রায় দুই বছর আগে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছি। তিনি নিয়োগ পরীক্ষার দুই দিন আগে আমার কাছে অফিস সহকারী পদের জন্য ১৬ লাখ টাকা চেয়েছিলেন। এত টাকা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয় বলে চেয়ারম্যানকে বলেছি। তখন আমাকে বলেছেন, টাকা যার চাকরি তার। একই পদে অনেকের কাছে টাকা নেওয়ার কথা জেনেছি।
জামুহালী গ্রামের বাসিন্দা আজিজার রহমান বলেন, আমার ছেলে সৌরভ হোসেন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে আবেদন করেছেন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবু নাছের রেজাউল করিমের সঙ্গে আমার ১৫ লাখ টাকা চুক্তি হয়েছিল। দুই মাস আগে প্রথমে অধ্যক্ষ সাহেব আমাকে দাতা সদস্য মতিউর রহমানকে আড়াই লাখ টাকা দিতে বলেছিলেন। অধ্যক্ষের কথামতো তাকে আড়াই লাখ টাকা দিয়েছি। এরপর নিশ্চিন্তা বাজারের একটি রড-সিমেন্টের দোকানে বসে অধ্যক্ষ সাহেব আমার কাছে সাড়ে ৭ লাখ টাকা নিয়েছেন। মোট ১০ লাখ টাকা দিয়েছি। এখন ওই পদের জন্য আরও বেশি টাকা পেয়ে অধ্যক্ষ সাহেব আমার ছেলের নিয়োগে গড়িমসি করছেন।
বড়তারা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন লতিফ বলেন, এখানে দক্ষ, ভালো ও শিক্ষিতরা চাকরি করুক। কিন্তু নিয়োগের নামে বাণিজ্য হচ্ছে। ডিগ্রি আছে কি-না আমরা তাও জানি না। টাকার বিনিময়ে সেরকম লোকদের তারা নিয়োগ দিচ্ছে। আমরা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজনের দাবি করছি।
ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ অস্বীকার করে মাদরাসার অধ্যক্ষ আবু নাছের রেজাউল করিম বলেন, এসব বিষয়ে মাদরাসার সভাপতি জানেন। আমি দূরে থাকি। আমি কেন টাকা নেব? আর মাদরাসার উপাধ্যক্ষসহ পাঁচটি পদে মোট ৪৮ জন প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। শুক্রবার সকাল ১০টায় পাঁচটি পদে মাদরাসায় নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ডিজির প্রতিনিধি আসবেন না বলে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বড়তারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও জামুহালী চশমায়ে উলুম দ্বিমুখী আলিম মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি বোরহান উদ্দিন বলেন, মাদরাসায় জনবল নিয়োগে কারও কাছে একটি টাকাও নেওয়া হয়নি। কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না।
ক্ষেতলাল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ছফিউল্লা সরকার বলেন, ওই মাদরাসায় পাঁচটি পদে নিয়োগের ব্যাপারে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। শুক্রবার নিয়োগ বোর্ড ছিল, সেটিও জানি না আবার নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে সেটিও জানা ছিল না। পরে লোক মাধ্যমে জেনেছি।
চম্পক কুমার/আরকে