বগুড়ায় মেডিকেলে চান্স পেলেন এক মায়ের তিন সন্তান
স্কুলশিক্ষক বাবা মারা গেছেন প্রায় এক যুগ আগে। এরপর থেকেই পরিবারের হাল ধরেন মা আর্জিনা বেগম। পরিবারে অভাব থাকলেও একসঙ্গে জন্ম নেওয়া তিন সন্তানকে সেটা বুঝতে দেননি তিনি। তবুও সন্তানদের পড়ালেখার ব্যাপারে আপস করেননি তিনি। অবশেষে মায়ের সেই পরিশ্রম সার্থক করেছেন মো. মাফিউল হাসান, মো. সাফিউল ইসলাম ও মো. রাফিউল হাসান। তিনজনই এবার মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।
অনেকটা ব্যতিক্রম এই ঘটনা ঘটেছে বগুড়ার ধুনট উপজেলার বথুয়াবাড়ী গ্রামে। তাদের বাবা গোলাম মোস্তফা স্কুলশিক্ষক ছিলেন। ২০০২ সালে ৩০ নভেম্বর গোলাম মোস্তফা ও আর্জিনা বেগমের ঘরে এক সঙ্গে তিন ছেলের জন্ম হয়। ২০০৯ সালে তাদের বাবা মারা যান। এরপর থেকে মা আর্জিনা বেগমই তার তিন ছেলেকে আগলে রেখেছেন। নিজের সর্বস্ব দিয়ে ছেলেদের সুশিক্ষিত হিসেবে বড় করতে সংগ্রাম করে গেছেন। তার ফলও পেয়েছেন তিনি।
সরেজমিনে সোমবার বিকেলে বথুয়াবাড়ী গ্রামে গিয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য তাদের প্রচেষ্টা গল্প নিয়ে আলাপ হয়। তিন ভাই মাধ্যমিক পড়ালেখা শেষ করেছেন ধুনট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ২০২০ সালে সেখান থেকে তারা এসএসসিতে সব বিষয়ে এ প্লাস পেয়ে পাস করেন। এরপর উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য তারা ভর্তি হন বগুড়ার সরকারি শাহ সুলতান কলেজে। ২০২২ সালেও তিন ভাই সব বিষয়ে এ প্লাস পান।
তবে ২০২৩ সালে প্রথমবারের চেষ্টায় তিন ভাইয়ের মাঝে শুধু মো. মাফিউল হাসান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। এ বছর সেই আফসোস পুষিয়ে নিয়েছেন বাকি দুই ভাই। এবারের ভর্তি পরীক্ষায় মো. সাফিউল ইসলাম দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল ও মো. রাফিউল হাসান নোয়াখালীর আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।
উচ্চ মাধ্যমিকে থাকার সময় মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন বোনা শুরু হয় বলে জানান রাফিউল হাসান। তিনি বলেন, ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার জন্য বগুড়ায় থাকা শুরু। তখন বায়োলজি পড়তে ভালোই লাগতো। ইঞ্জিয়ানিয়ারিংয়ের জন্য গণিত লাগে। কিন্তু গণিত কম পছন্দ করতাম। এজন্য মেডিকেলের দিকে অগ্রসর হই। তারপর মনে হলো ডাক্তারি একটা মহান পেশা। এ পেশার মাধ্যমে মানুষকে সরাসরি সেবা দেওয়া যায়।
মেডিকেলে ভর্তির জন্য পরিশ্রমের পাশাপাশি ভাগ্যও লাগে বললেন রাফিউল। তারা তিন ভাই চিকিৎসাশাস্ত্রের পড়ার সুযোগ পাওয়ায় অনেক খুশি তিনি।
রাফিউল আরও বলেন, তিন ভাইয়ের এক সঙ্গে মেডিকেলে পড়ার সুযোগ সাধারণত দেখা যায় না। অনেক সময় এক গ্রামে হয়তো একজন সুযোগ পায়। সেখানে তিন ভাই এমন সুযোগ পাওয়া বিরল ঘটনা। প্রথমবার চান্স না পেয়ে খারাপ লাগেনি। বরং মনে হয়েছে, এই যে টাকা খরচ হয়েছে তার কিছুটা উসুল হলো। আর আমাদের তো আরেকবার সুযোগ ছিল, তাই ভেঙে পড়িনি।
প্রথমবার পরীক্ষায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের দন্ত বিভাগে পড়ার সুযোগ পান মাফিউল হাসান। তবে ভর্তি হয়েও মন খারাপ ছিল বাকি দুই ভাইয়ের জন্য। মাফিউল বলেন, সায়েন্সের ছাত্র হিসেবে সবার মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দিকে ফোকাস করা উচিত। নিপীড়িত মানুষের কাছে সবচেয়ে খারাপ সময়ে সেবা দেওয়ার একটা জায়গা হলো ডাক্তারি পেশা। সেখান থেকে মূলত ডাক্তারি পেশায় আসার প্রবল ইচ্ছা ছিল আমার। সেই কারণে তিন ভাই মেডিকেল প্রিপারেশন নেওয়া শুরু করি।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রথমবার আমার হলেও দুই ভাইয়ের অল্পের জন্য মিস হয়। এজন্য আমিও কষ্ট পেয়েছিলাম। তারপর পরবর্তী সময়ে তারা পুনরায় স্টার্ট করে। সেই ধারাবাহিকতায় দুই ভাইও সরকারি মেডিকেলে চান্স পায়। যারা আমাদের দুঃসময়ে পাশে থেকেছে তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
সাফিউল ইসলাম বলেন, আমার ইচ্ছা গ্রামের মানুষ যারা গরিব, দিনমজুর, রিকশাওয়ালা ও হুজুরদের নিয়ে কাজ করা। আমি যখন ভালো ডাক্তার হবো, ছুটিতে এলে তাদের ফ্রি চিকিৎসা দেব।
তিন ছেলের মা আর্জিনা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এরা ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় ভালো ছিল। ভালো রেজাল্ট করেছে। আলাদা কোনো গাইড দেওয়া লাগেনি। নিজের ইচ্ছায় তারা পড়ালেখা করেছে। পাইলট স্কুল থেকে গোল্ডেন এ প্লাস পায়। তখন ঠিক করলাম, লেখাপড়া ভালো মতো করাব। শিক্ষকের ছেলে, যেন তার নাম থাকে। তখন তাদের পেছনে টাকা খরচ করেছি, যাতে মানুষের মতো মানুষ হয়। তারপর তারা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। এজন্য আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।
সন্তানদের পড়ালেখা করাতে নিজের জমি বিক্রি করেছেন আর্জিনা বেগম। বললেন, আমার শেরপুরের জমিটা বিক্রি করেছি। বাপের বাড়ির জমি ছিল সেটাও বিক্রি করেছি। জমি বিক্রি করেই এতদূর পড়াইছি। এখন সরকার যদি আমার ছেলেদের পড়ালেখার খরচটা দেখে তাহলে উপকার হয়।
মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পাওয়া তিন ভাইয়ের চাচা ও ধুনট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম ফারুক বলেন, ওদের বাবা তো ২০০৯ সালে মারা যান। তিনি ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষক। ওদের মা এই সংসারের হাল ধরেছেন। ওদের মা অনেক কষ্ট করে সন্তানদের পড়ালেখা করিয়েছে। অর্থনৈতিক সমস্যা ছিল। কিন্তু পড়ালেখা চালিয়ে গেছে। আমরাও তাদের উৎসাহিত করেছি।
আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/আরকে