অনন্য স্বাদের গুঠিয়ার সন্দেশ, জিআই পণ্যের স্বীকৃতির দাবি
ঘটনাটি ষাটের দশকে। নদীয়ায় আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে প্রথম পরিচয় হয়েছিল সাদা ধবধবে এক ধরনের মিষ্টান্নের সঙ্গে। কিছুটা নরম, আকৃতিগত দিক থেকে এবড়ো-থেবড়ো। সেই মিষ্টান্নে মন ভরছিল না সতীশ চন্দ্র দাসের। গুঠিয়ায় ফিরে এসে নদীয়ার মিষ্টান্ন আর নিজের মিষ্টি তৈরির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তৈরি করেন গুঠিয়ার সন্দেশ।
দূর থেকে দেখতে শিউলি ফুলের মতই। নতুন এই মিষ্টান্ন বাজারজাতকরণে তিনি সঙ্গে নেন বন্ধু সমতুল্য ব্যবসায়ী বাদশা হাওলাদারকে। তারা দুজনেই নতুনভাবে উৎপন্ন সন্দেশ বিক্রি করে সারা ফেলে দেন। সতীশ চন্দ্র দাসের আরেক নাম সতীশ ময়রা।
সতীশ ময়রা ও বাদশা হাওলাদার দুজনের কেউই এখন আর বেঁচে নেই। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ মিষ্টান্ন গুঠিয়ার সন্দেশ বরিশাল অঞ্চলে বিখ্যাত হয়ে গেছে। গুঠিয়ার গ্রাম্য হাটের জৌলুস কমেছে, পাশের বিশাল খালটি তার নাব্যতা হারিয়েছে। কিন্তু সন্দেশের বাজার আজও জমজমাট। প্রতিদিন দেশ ও দেশের বাইরের সহস্রাধিক ভোজনরসিক এই মিষ্টান্নের স্বাদ পেতে ঢু মারেন গুঠিয়ায়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজার পেলে সেখানেও বাজিমাত করবে গুঠিয়ার সন্দেশ। ভোক্তাদের দাবি অত্যন্ত জনপ্রিয় এই খাদ্যপণ্যকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার।
যদিও বাঙালির খাদ্যপণ্যের তালিকায় সন্দেশ নতুন নয়। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং চৈতন্যের কবিতায় সন্দেশের উল্লেখ রয়েছে। ওই মিষ্টান্নটির মূল উপাদান অজানা। সেই সন্দেশ তৈরি করতে ক্ষীর লাগতো। কিন্তু ক্ষীরের পরিবর্তে ঠিক কোন শতাব্দীতে ছানা ব্যবহার শুরু হয়েছে তা নির্ণয় হয়নি। বেশ কিছু দলিল-দস্তাবেজ থেকে জানা গেছে, উনিশ শতকের শেষ দিকে ছানার সন্দেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে গুঠিয়ার সন্দেশের ব্যুৎপত্তি এই বাজারেই। ১৯৬২ সালের দিকে পথচলা শুরু হয় বলে স্থানীয়রা জানান।
সন্দেশ সাধারণত নরম ও লঘুপাকের হয়। কিন্তু গুঠিয়ার সন্দেশ ঠিক তার উল্টো, কড়াপাকের। এ জন্য এ সন্দেশ হয় কিছুটা শক্ত ও শুষ্ক। অন্যসব জায়গায় ক্ষীর সন্দেশ, সরপুরি, সাদা সন্দেশ, গুড়ের সন্দেশ, পোড়া সন্দেশের মত হরেক নামে সন্দেশ পেলেও গুঠিয়ার সন্দেশ প্রধানত এক পল্লার ও দুই পল্লার। দুই পল্লার সন্দেশকে ডাকা হয় জোড়া সন্দেশ নামে।
গুঠিয়া বাজারে এখন মাত্র ৭টি সন্দেশের দোকান চালু রয়েছে। এরমধ্যে একটি মাহিয়া মিষ্টান্ন ভান্ডার। এর স্বত্বাধিকারী টিটুল হাওলাদার জানান, প্রতিদিন যত মানুষ এই বাজারে মিষ্টান্ন নিতে আসেন তার আশি ভাগই সন্দেশ নিতে আসেন। সন্দেশ শুধু নিজে খান এমন না স্বজনদের জন্য নিয়ে যান। দেশের বাইরেও অনেকে নিয়ে যান।
টিটুল বলেন, প্রতিদিন হাজার হাজার পিস সন্দেশ তৈরি করতে হয়। সন্দেশ তৈরির জন্য কারিগরদের একটি কক্ষ আলাদা করা আছে। ওখানে দিনের সারাক্ষণ সন্দেশ তৈরি হয়।
এই দোকানের কর্মচারী মিন্টু হাওলাদার বলেন, আসল গুঠিয়ার সন্দেশ তৈরিতে কোনো ধরনের ভেজাল দ্রব্য দেওয়ার সুযোগ নেই। কিছু কিছু লোক সন্দেশে ময়দা মিশিয়ে ওজন বাড়ায়। এতে স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। আমরা গুণগত মান ঠিক রেখে সন্দেশ বিক্রি করি।
আরেকজন বিক্রেতা শাওন হাওলাদার বলেন, সন্দেশের চাহিদা দেশ ও দেশের বাইরে অনেক। কিন্তু দুধ, চিনির দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে আর আগের দামে সন্দেশ বিক্রি করতে পারছি না। তার উপর আয়কর অফিস আমাদের ওপর বিনা কারণেই বাড়তি কর ধার্য করছেন।
সন্দেশ দাস বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষ থেকে বিখ্যাত সন্দেশের মান ও খ্যাতি আজও আমরা ধরে রেখেছি। বাজারদরে কিছুটা হিমশিম খেলেও সরকার আমাদের দিকে নজর দিলে আমরা আরও ভালোভাবে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারব।
আরেক কারিগর শ্যামল চন্দ্র ভদ্র বলেন, আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন সতীশ চন্দ্র দাস। তিনি যে পদ্ধতিতে সন্দেশ তৈরি করতেন আমরা এখনো সেভাবেই তৈরি করে থাকি। এজন্যই গুঠিয়ার সন্দেশের সঙ্গে দেশের আর কোনো জায়গার সন্দেশ মিলবে না। আমরা খাটি দুধ ও চিনি ব্যবহার করি।
তিনি আরও বলেন, খাটি পণ্য বিক্রি করায় ঢাকায় চিন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রেন সরকার আমাকে পুরস্কৃত করেছেন। সরকার আশ্বস্ত করেছে ঐতিহ্যবাহী খাদ্যপণ্য তারা আন্তর্জাতিকভাবে বাজারজাত করবে। সেই সুযোগ পেলে গুঠিয়ার সন্দেশ নিঃসন্দেহে বিশ্ব বাজারও জয় করবে।
সন্দেশ কারিকর নিটুল হাওলাদার, রিপন মন্ডল ও হাফিজুর সরদার বলেন, সাধারণত ছয়-সাত কেজি দুধে এক কেজি ছানা পাওয়া যায়। সেই ছানার সঙ্গে পরিমাণ মত চিনি মিশিয়ে অল্প আগুনে উত্তপ্ত করে নিতে হয়। ২০-৩০ মিনিট পর পাকিয়ে অল্প আঁচে পাঁচ মিনিট রাখলেই কাঁচামাল তৈরি। দুধ থেকে ছানা তৈরির পর তা দিয়ে সন্দেশ তৈরি হয়। ছানা বেশি সময় রেখে দিলে ভালো সন্দেশ হয় না। এ জন্য দুধ থেকে ছানা কাটার পর পরই তা একটি বড় লোহার কড়াইতে জ্বাল দেওয়া হয়। কাঁচা ছানার সঙ্গে কিছু ময়দাও মেশানো হয়। জ্বাল হওয়ার পর তা কিছুটা চিকন করা হয়। জ্বালের কম-বেশির ওপরেই এ সন্দেশের স্বাদ ও গুণগত মান নির্ভর করে। পাকের পর তা চুলা থেকে নামিয়ে ছোট গোল্লা করে চ্যাপ্টা করা হয়। এরপর তার ওপরে মাঝখানে একটি পরিষ্কার কিশমিশ দানা বসিয়ে দেওয়া হয়। এতে সন্দেশের সৌন্দর্য বাড়ে। সন্দেশ তৈরিতে পরিমাণমতো আঁচ ও পাকই হলো মূল।
ক্রেতা আবু সালেহ বলেন, আমি দেশের বিভিন্ন জনপদে ঘুরেছি। অঞ্চলভেদে ঐতিহাসিক খাবার খেয়েছি। কিন্তু গুঠিয়ার সন্দেশের স্বাদ অনন্য। সুযোগ পেলেই আমি এই সন্দেশ খেতে আসি।
ডা. এমএ হালিম বলেন, গুঠিয়ার সন্দেশে ভেজাল কিছু দেওয়া হয় না। এই সন্দেশ থেকে খাঁটি গরুর দুধের ঘ্রাণ আসে। আমি যতবারই খেয়েছি ততবারই মনে হয়েছে এমন মিষ্টান্ন আর কোথাও নেই।
মানস ঘোষ বলেন, আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই, গুঠিয়ার সন্দেশ জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
লেখক ও গবেষক আনিসুর রহমান খান স্বপন বলেন, গুঠিয়ার সন্দেশ প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে খ্যাতি ও মান বজায় রেখে চলেছে। এর দুটি কারণ। প্রথমত গুণগত মান। দ্বিতীয়ত সন্দেশটির আকার-আকৃতি। গুঠিয়ার সন্দেশ ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে বরিশালের। একই নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্দেশ পাওয়া গেলেও সেগুলো গুঠিয়ার সন্দেশের মত নয়। আমি মনে করি ঐতিহ্যবাহী এই পণ্যটি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। সেইসঙ্গে সরকার উদ্যোগ নিলে সন্দেশের মান অক্ষুণ্ন রেখে বিশাল একটি অর্থনৈতিক উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে গুঠিয়ার সন্দেশ।
উজিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, গুঠিয়ার সন্দেশ এই অঞ্চলের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় একটি মিষ্টান্ন। খাদ্যপণ্যটি জিআই পণ্য ঘোষণার বিষয়ে যে-সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার তাতে উপজেলা প্রশাসন সবসময়ে ব্যবসায়ীদের সহায়তা করবে।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/এএএ