‘বাজানের হপ্পন রাইতের আগুনে ছাই হইয়্যা গ্যাছে’
‘গরিব মানষের হপ্পন (স্বপ্ন) দ্যাখতে নাই। মুই আর কি কমু? কতা কওয়ার শক্তি নাই। সজীবের ইচ্ছা আছিল যত কষ্টই হউক, শিক্ষিত হইয়্যা বড় হইবে। একটা চাকরি নিবে। আমার বাজানের হপ্পন রাইতের আগুনে পুইড়া ছাই হইয়্যা গ্যাছে। লগে মোগো হপ্পনও শ্যাষ।’
অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কথাগুলো বলছিলেন বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠি ইউনিয়নের বাসিন্দা কালাম জমাদ্দার। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে ছেলের মরদেহ বুঝে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) বিকেলের চিত্র এমন। ক্ষীণ স্বরে অল্প কয়েকটি কথা বলে আবার নির্বাক হয়ে যান মাঝ বয়সী কালাম।
স্ত্রী, দুই কন্যা আর একমাত্র ছেলে সজীব জমাদ্দারকে নিয়ে তার সংসার। প্রতিবেশীরা অর্থনৈতিক সচ্ছলতা থাকায় তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য খরচ দিতে পারতো পরিবার থেকে। কিন্তু কালাম জমাদ্দারের সেই সামর্থ্য ছিল না। নিজে দিনমজুর। অল্প কয়েকদিন হলো সবজির ব্যবসা করছেন। তরকারি বিক্রি করে সংসার চালাতে কষ্ট হতো। তাই ছেলে সজীবকে বরিশাল শহরে রেখে লেখাপড়া করানোর সক্ষমতা ও সাহস কোনটাই ছিল না।
সজীবের ইচ্ছা ছিল অদম্য। অভাব-অনটনের সংসারে মাধ্যমিকে মনোঃপুত রেজাল্ট করতে না পারলেও দ্রুত চাকরির কাছে পৌঁছানো যায় সেই বুদ্ধিতে ভর্তি হন বেসরকারি একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। পাশাপাশি জিয়া সড়কের হাবিব মটরসে মাসিক ৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন। দিনে কলেজে ক্লাস সেরে বিকেলে দোকানে ফিরতেন। সেখানেই রাতে থাকতেন।
সজীবের বন্ধু সৌরভ মিস্ত্রী বলেন, এসএসসির ফলাফল খুব ভালো করতে পারেনি সজীব। কিন্তু সে অনেক মেধাবী ছিল। নানান কারণে তার ফলাফল ভালো হয়নি। পড়াশোনা করে অনেক বড় হওয়ার তাগিদ ছিল ওর মধ্যে। সব সময়ে লেখাপড়া নিয়ে আলোচনা করত। বিভিন্ন চাকরির খোঁজ খবর রাখতো। ওর মা-বাবা, বোনদের নিয়ে গল্প করত। ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে সবার দুঃখ লাঘবে হাল ধরবে। কিন্তু সব কিছু শেষ হয়ে গেল। আমার বন্ধুর এমন মর্মান্তিক মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না।
ইনফ্রা পলিটেকনিট ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রনিক্স বিভাগের প্রধান নূরুল হুদা বলেন, পলিটেকনিকে প্রতিটি সেমিস্টারে সজীব ভালো ফলাফল করেছে। ও খুব বিনয়ী আর লেখপড়ায় মনোযোগী ছিল। পরিবারের অসচ্ছলতার কথা আমরাও জানতাম। ওর সংগ্রাম করে লেখপড়া করার উদাহরণ অন্যদের দিতাম। সজীবকে নিয়ে আমাদের প্রত্যাশাও ছিল অনেক। কিন্তু সব কিছু এভাবে থেমে যাবে তা ভাবিনি। এই দুঃখ ভাষায় প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
কলসকাঠি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফয়সাল ওয়াহিদ বলেন, আমার গ্রামেরই ছেলে সজীব। ছোটবেলা থেকে ওরা অভাব অনটনের সাথে লড়াই করে বড় হয়েছে। তবে সজীবের সুনাম ছিল এলাকায়। আমাদের প্রত্যাশা ছিল সজীব তার আত্মবিশ্বাস দিয়ে একটা কিছু করে দেখাবে। সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল লেখপড়া করে। কিন্তু একটি অগ্নিকাণ্ড সবার আশার সমাপ্তি ঘটালো।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার ময়নাতদন্ত শেষে মরদহ বুঝে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে দাফন সম্পন্ন করেছি। ওর পরিবারকে সর্বাত্মক সহায়তা করছি। উপজেলা প্রশাসন থেকেও সহায়তা করছে।
উল্লেখ্য, বরিশাল নগরীর জিয়া সড়ক এলাকায় গত সোমবার (২৯ জানুয়ারি) দিবাগত রাতে চারটি দোকানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই সময় দোকানের মধ্যে থাকা কলেজছাত্র সজীব জমাদ্দার মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ইনফ্রা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রনিক্স বিভাগের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর