ভরা মৌসুমেও নওগাঁয় চালের দাম বাড়ছে কেন?
নওগাঁয় আমন ধান কাটা-মাড়াই শেষ হয়েছে আরও দুই সপ্তাহ আগে। নতুন ধান থেকে উৎপাদিত চাল বাজারে এসেছে ডিসেম্বরের শুরুতেই। বর্তমানে চলছে আমনের ভরা মৌসুম। স্বাভাবিকভাবে এই মুহূর্তে চালের দাম কম থাকার কথা। তবে বাজারে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। হঠাৎ করে প্রতি কেজি চালের দাম ২-৩ টাকা বৃদ্ধি করে দিয়েছেন জেলার চাল ব্যবসায়ীরা। বিষয়টিকে ‘সিন্ডিকেট’ হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভোক্তারা।
শহরের পৌর খুচরা চাল বাজারে বর্তমানে মানভেদে প্রতি কেজি জিরাশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এই চাল বিক্রি হয়েছে ৬০-৬২ টাকায়। প্রতি কেজি কাটারীভোগ চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এই চাল বিক্রি হয়েছে ৬৫-৬৮ টাকা। প্রতি কেজি স্বর্ণা-৫ চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮-৫০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এই চাল বিক্রি হয়েছে ৪৬-৪৮ টাকায়। প্রতি কেজি ব্রিধান-২৯ ও ৪৯ চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৪-৫৬ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এই চাল বিক্রি হয়েছে ৫২-৫৪ টাকায়।
খুচরা বাজারে চাল কিনতে আসা রিকশাচালক ছোলেয়ামান সরদার বলেন, নির্বাচনের কারণে এমনিতেই রাস্তাঘাটে মানুষ কম বের হয়েছে। তাই গত মাসের তুলনায় দৈনিক আয় কমেছে অন্তত ১০০ টাকা। এর মধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যাদির পাশাপাশি চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকলে গরিব মানুষরা না খেয়ে মরবে।
হাঁট নওগাঁ মহল্লার বাসিন্দা ইশাতির রাদী জয় বলেন, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রতি কেজি জিরাশাইল চাল কিনেছিলাম ৬০ টাকায়। সেই চাল কিনতে হলো ৬৫ টাকা কেজি দরে। নির্বাচনের পর নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের পাশাপাশি চালের বাজারে রীতিমতো আগুন লাগার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
তাপস খাদ্যভান্ডারের খুচরা চাল বিক্রেতা তাপস কুমার মন্ডল বলেন, আমনের ধান ডিসেম্বরের শুরুতে বাজারে আসলে স্বর্ণা-৫ খুচরাতেই ৪৩-৪৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পর্যাপ্ত উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও সেই চালের দাম বেড়েছে। কাটারীভোগ এবং জিরাশাইলেরও আংশিক আবাদ হয় আমন মৌসুমে। সেই চালের দামেও পরিবর্তন। আমরা ১ সপ্তাহ যাবত বেশি দামে চাল কিনছি। তাই প্রতি কেজিতে ২-৩ টাকা বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। খুচরা বাজারে কোনো সিন্ডিকেট হয় না, পাইকারীতে অভিযান শুরু হলেই চালের বাজারে স্বস্তি ফিরবে।
জেলার সবচেয়ে বড় চালের মোকাম পার নওগাঁ মহল্লার আড়তদার পট্টিতে বর্তমানে পাইকারী পর্যায়ে মানভেদে প্রতি কেজি স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৪৫-৪৭ টাকায়, জিরাশাইল ৬৩-৬৪ টাকায় এবং কাটারীভোগ ৬২-৬৬ টাকায় কেনাবেচা করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। যেখানে সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি স্বর্ণা-৫ ধানে দাম বেড়েছে ২ টাকা। প্রতি কেজি জিরাশাইল ও কাটারীভোগ চালে বেড়েছে ২-৩ টাকা।
সততা রাইচ এজেন্সির প্রোপাইটর সুকুমার ব্রহ্ম বলেন, বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে খুব বেশি ধান মজুত নেই। কিছু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং মজুতদাররা ধান কিনে বাজারে সরবরাহ সংকট সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনের পর থেকে এই সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই চালের বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। তাই চালের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। মজুতদাররা বাজারে ধানের সরবরাহ স্বাভাবিক করলে বাজারে স্বস্তি ফিরবে।
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের ধানের দাম বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি মণ স্বর্ণা-৫ ধান ১ হাজার ৩১০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। এই দামে দেড় মণ ধান কেনার পর সেখান থেকে ৪১ কেজি চাল পাওয়া যায়। যেখানে প্রতি কেজি স্বর্ণা-৫ চাল তৈরিতে মিলারদের খরচ গুনতে হয় ৪৭ টাকা ৯২ পয়সা। অথচ মিলাররা বর্তমানে প্রতি কেজি স্বর্ণা-৫ চাল বিক্রি করছেন সর্বোচ্চ ৪৭ টাকায়। যা উৎপাদন খরচের চেয়েও কম।
তিনি আরও বলেন, পূর্বে কম দামে কেনা ধান এবং বর্তমানে বেশি দামে কেনা ধানের মূল্য সমন্বয় করেই স্বর্ণা-৫ চাল ৪৭ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। ঠিক একইভাবে অন্য চালগুলোর মূল্য কমবেশি হয়েছে। সরকারি গুদামে চাল দিলেই এখন প্রতি কেজি চালে ৪৪ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। সেই তুলনায় আমন মৌসুমে বর্তমান চালের বাজার মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এটা স্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি।
নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মুহাম্মদ তানভীর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর আমনের রেকর্ড পরিমাণ ফলন হয়েছে। এ অবস্থায় চালের দাম রাতারাতি বেড়ে যাওয়া মোটেও স্বাভাবিক নয়। আগামী ১৭ জানুয়ারি বিকেল ৩টায় ঢাকায় খাদ্য অধিদপ্তরে ‘ধান চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী রোধকল্পে মতবিনিময় সভা’ অনুষ্ঠিত হবে। সভায় খাদ্যমন্ত্রী এবং খাদ্য সচিব থাকবেন। যেখানে চালকল মালিকসহ খাদ্য বিভাগের জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ডাকা হয়েছে। সেখানে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে একটি নির্দেশনা প্রদান করবেন খাদ্যমন্ত্রী। এরপর নির্দেশনা অনুযায়ী চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে খাদ্য বিভাগ।
আরএআর