মতলব হাসপাতালে প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে ২৫০ জন ডায়রিয়া রোগী
সারাদেশে জেঁকে বসেছে শীত। তীব্র শীতে ডায়রিয়াসহ ঠান্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। শীত মৌসুমে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলায় অবস্থিত আইসিডিডিআরবিতে (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ) ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। গড়ে দৈনিক ২৫০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছে। এদের অধিকাংশই শিশু। বেশিরভাগই রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা রোটা ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হয় বলে জানান চিকিৎসকরা।
তবে অভিভাবকদের আতঙ্কিত না হয়ে রোগীদের স্থানীয় সরকারি হাসপাতাল বা মতলব হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালটি ১০০ শয্যার হলেও অতিরিক্ত রোগী নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রতিনিয়ত এই হাসপাতালে ছুটে আসেন রোগীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চাঁদপুরের মতলব আইসিডিডিআরবিতে গত ২০২৩ ডিসেম্বরে ৯ হাজার ৩২ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। তার মধ্যে বিভিন্ন বয়সের ৭ হাজার ৯৯৭ জন শিশু রয়েছে। এদের মধ্যে দুই বছরের কম বয়সী শিশু ৭ হাজার ৪২১ জন। তবে এর আগে ২০২২ সালে একই সময় চিকিৎসা নিয়েছিল ৭ হাজার ৫৫১ রোগী। নতুন বছরের প্রথম ১৪ দিনে ভর্তি হয়েছে ৩ হাজার ২২১ জন। তার মধ্যে বিভিন্ন বয়সের ২ হাজার ৮৬৬ জন শিশু রয়েছে। এদের মধ্যে দুই বছরের কম বয়সী শিশু ২ হাজার ৬৮৫। আজ সোমবার (১৫ জানুয়ারি) মোট নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে ১৫০ জন।
আইসিডিডিআরবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রোটা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত চাঁদপুর সদর, ফরিদগঞ্জ, কচুয়া, বরুড়া, বুড়িচং, চান্দিনা, মুরাদনগর, লক্ষ্মীপুর সদর ও চাটখিল উপজেলার শিশুরা। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে আক্রান্তের হার কমবে।
সন্তানের চিকিৎসা করাতে চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলা থেকে এসেছেন সাথী আক্তার। তিনি জানান, শিশু সন্তানকে কচুয়াতে ডাক্তার দেখিয়েছেন। ওই ডাক্তারের পরামর্শে মতলব আইসিডিডিআরবিতে নিয়ে এসেছেন। এখানে চিকিৎসা করিয়ে তার সন্তান আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে।
হাইমচর থেকে আসা উর্মি আক্তার বলেন, গত তিন দিন ধরে আমার বাচ্চার বমি, জ্বর, পাতলা পায়খানা । স্থানীয় ডাক্তারদের চিকিৎসায় ভালো হচ্ছে না। তাই এখানে নিয়ে আসলাম। এখন বাচ্চার অবস্থা আগের থেকে অনেকটা ভালো।
কুমিল্লা থেকে আসা সালমা বেগম বলেন, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাচ্চাকে নিয়েছিলাম। সে সুস্থ্য হয়নি। তাই তাকে এখানে নিয়ে আসলাম। এখানে চিকিৎসার নেওয়ার পর এখন বাচ্চা অনেকটা সুস্থ আছে।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে আসা রোশন আরা বেগম বলেন, আমার দুই বাচ্চা বমি, জ্বর, পাতলা পায়খানা শুরু করে। স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি। কিন্তু সুস্থ হয়নি। তাই এখানে নিয়ে আসলাম। এখন একটি বাচ্চা সুস্থ হয়েছে। আরেকটি বাচ্চা সুস্থ হাওয়ার পথে। আশা করি সেও সুস্থ হয়ে যাবে।
লক্ষ্মীপুর থেকে আসা শহীদ বলেন, শিশুর হঠাৎ বমি, জ্বর, পাতলা পায়খানা শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়া হলেও ভালো হয়নি। পরে এই হাসপাতালে নিয়ে আসি। এখন সুস্থ, বাড়ি নিয়ে যাব।
হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক ক্লিনিক্যাল ফেলো নুজহাত সাদিয়া বলেন, শীত মৌসুমে বাচ্চারা রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয় বেশি। এ রোগে আক্রান্ত হওয়ায় রোগীরা সুস্থ হতে ৫-৭ দিন লাগে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ না হলে আমাদের এখানে আসে। আমরা তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকি। যদি দেখি তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন নেই, তাহলে প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং ওষুধপত্র দিয়ে রিলিজ করে দেই। তবে সাধারণত বাচ্চাদের এখানে ৪-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত রাখা হয়। যদি তাদের অবস্থা ভালো হয় তাহলে ছুটি দিয়ে দেই। না হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেই।
আইসিডিডিআরবি মতলব হেলথ রিসোর্স সেন্টারের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. চন্দ্র শেখর বলেন, চলতি বছরের ১-১৪ জানুয়ারি প্রতিদিন প্রায় ২৩০ জন করে রোগী ভর্তি যাচ্ছে। এর আগে গত ডিসেম্বর মাসে প্রতিদিন প্রায় ২৯০ জন করে রোগী ভর্তি হয়। আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশ রোগীই শিশু। এখানে শিশু রোগীদের শতকরা ৮৫ ভাগ দুই বছর বয়সের নিচে। তাদের মধ্যে অধিকাংশ শিশুই রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত। এই রোগ শীত আসলে বেশি হয়। এ রোগের লক্ষণ হচ্ছে- শিশুর সাধারণত পাতলা পায়খানা থাকে, একই সঙ্গে বমি থাকতে পারে। এছাড়া জ্বরও থাকতে পারে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এ ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুদের সুস্থ হতে ৫-৭ দিন সময় লাগে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এ হাসপাতালটি ১০০ বেডের। বছরের স্বাভাবিক সময়ে গড়ে ১০০ জন রোগী ভর্তি হয়। কিন্তু প্রতি বছর শীতকাল ডিসেম্বর , জানুযারি, ফেব্রুয়ারি এই তিন মাস তার চেয়ে তিনগুণ রোগী বেড়ে যায়। আমাদের ১০০ বেডের হাসপাতাল হলেও চিকিৎসক, নার্স, স্টাফসহ পর্যাপ্ত পরিমাণ জনবল আছে। পর্যাপ্ত ওষুধ, স্যালাইনের ব্যবস্থা আছে। এখানে প্রতিদিন যদি সাড়ে ৩শ রোগীও ভর্তি হয়, তাহলেও তাদের সঠিকভাবে চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠাতে পারব। চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, শরীয়তপুরসহ প্রায় ৩৫টি উপজেলা থেকে এখানে প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছে।
ডা. চন্দ্র শেখর বলেন, আজ এখানে ১৭০ জন রোগী চিকিৎসাধীন আছে। ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত এখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কোনো রোগী মারা যায়নি।
আনোয়ারুল হক/আরএআর