‘জ্ঞান ফিরে দেখি স্থানীয়রা আমাকে ঘিরে রেখেছেন’
গত ৫ জানুয়ারি রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুনের ঘটনায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে। বেঁচে গেছেন অনেকেই। এ ঘটনায় রাজবাড়ীর তিনজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে একজন রাজবাড়ীর পীযুষ কান্তি সরকার মনোজ।
সেদিনের সেই ভয়াবহতা ও নৃশংসতা তিনি দেখেছেন নিজ চোখে। ট্রেনের প্রতিটি যাত্রীর বাঁচার আকুতি যে কতটা হৃদয়স্পর্শী তার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। বুধবার (১০ জানুয়ারি) কথা হয় তার সঙ্গে। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সেদিনের পুরো ঘটনা তুলে ধরেন তিনি।
পীযুষ কান্তি সরকার মনোজ রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের পাটুরিয়া গ্রামের মতিলাল সরকারের ছেলে। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক ও চিত্রশিল্পী।
মনোজ ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান, শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) তার ছোট ভাইয়ের শাশুড়ির শ্রাদ্ধ্যর অনুষ্ঠান শেষে তিনি ঢাকা ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা হন। নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি ট্রেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অনলাইনে ট্রেনের টিকিট না পেয়ে রাজবাড়ী রেলস্টেশন থেকে স্ট্যান্ডিং টিকিট সংগ্রহ করেন। সন্ধ্যা ৬টা ১৮ মিনিটে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাজবাড়ী রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে যায় রাজধানীর উদ্দেশ্যে। এরপর দ্রুতগতিতে চলতে থাকে ট্রেনটি। পদ্মা সেতু পার হয়ে সায়েদাবাদে ঢুকে পড়ে ট্রেন। হঠাৎ ‘চ’ বগি নিমিষেই কালো ধোঁয়ায় ভরে যায়।
তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন ডাকাত আক্রমণ করেছে। পোড়া গন্ধ আর কালো ধোঁয়ায় তিনি টের পান ট্রেনে আগুন ধরেছে। সেই সময় তার মাথা কোনো কাজ করছিল না। দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। বেঁচে থাকার আকুতি সবার। চোখের সামনে পুড়ছেন এক নারী যাত্রী। তার পুরো শরীরে আগুন। দিশা না পেয়ে ট্রেনের যাত্রীদের মালামাল রাখার জায়গা থেকে একটা লম্বা পাথর জাতীয় বস্তু দিয়ে তিনি ট্রেনের জানালার গ্লাস ভেঙে ফেলেন। জীবন বাঁচাতে চলন্ত সেই ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেন মনোজ। এরপর তার আর কিছুই মনে নেই। যখন তার জ্ঞান ফেরে তখন তিনি দেখতে পান স্থানীয়রা তাকে ঘিরে রেখেছেন। পরে সেখান থেকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাদের সহযোগিতায় ফেরেন ঢাকার বাসায়।
মনোজ আরও জানান, এ ঘটনার পর একদিন এক রাত তিনি কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। এখনো তিনি আতঙ্কে রয়েছেন। মৃত্যু যে কতটা ভয়ানক তা তিনি একেবারে কাছ থেকে দেখেছেন। এখনো ভাবলে গা শিউরে ওঠে তার। বাঁচার কী আকুতি ছিল সবার। কী বিভৎস। চোখের সামনে পুড়ছে স্ত্রী-সন্তানের দেহ। কিছুই করতে পারছেন না অসহায় স্বামী, অসহায় একজন বাবা।
শারীরীক ও মানসিকভাবে এখনো অসুস্থ মনোজ। চোখের সামনে শুধু ভাসছে- অসহায় মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি। তিনি বলেন, এ রকম মৃত্যু পৃথিবীতে যেন আর একজনেরও না হয়। শত্রুর মৃত্যুও যেন স্বাভাবিক হয়।
প্রসঙ্গত, বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুনের ঘটনায় এখনো নিখোঁজ রয়েছেন রাজবাড়ীর এলিনা ইয়াসমিন (৪০), চন্দ্রিমা চৌধুরী সৌমি (২৮) ও আবু তালহা (২৭)। তাদের তিনজনের বাড়িতেই চলছে শোকের মাতম।
মীর সামসুজ্জামান সৌরভ/আরএআর