‘এক সময় অন্যের বাড়িতে কাজ করেছি, এখন আমার খামারে একশ ভেড়া’
চার বছর আগের কথা মনে হলে অজান্তেই চোখে জল আসে মেহেরপুরের বৃদ্ধা ছায়া বিবির (৬০)। অভাব-অনটন আর দুঃখ-দুর্দশার সংসার ছিল তার। তবে এখন দিন বদলেছে ছায়া বিবির। ভেড়া পালন করে ভাগ্য বদলেছে তার। মাত্র দু’টি ভেড়া থেকে শুরু করেছিলেন, চার বছরে ছায়া বিবির ভেড়ার খামারে এখন রয়েছে একশ ভেড়া।
তার খামারের ভেড়ার দেখাশোনা করে তার বেকার ভাইয়ের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হয়েছে। প্রতি বছর দুই লাখ টাকার ভেড়া বিক্রি করেন ছায়া বিবি। অন্যের সহযোগিতা ছাড়াই পরিশ্রম করে ভাগ্য বদলানো ছায়া বিবি মেহেরপুরের মুজিবনর উপজেলার বল্লভপুর গ্রামের চিত্ত রঞ্জন বিশ্বাসের মেয়ে।
প্রায় বিশ বছর আগে অসুস্থ স্বামী বিমল বিশ্বাসের চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন ছায়া বিবি। অনেক চিকিৎসা করেও বাঁচানো যায়নি তার স্বামীকে। স্বামীর মৃত্যুর পর অভাব অনটনে একমাত্র ছেলে শেবাস্তিন মন্ডলকে নিয়ে পড়েন মহা বিপাকে। তার বাবা-মায়ের সংসারেও ছিল নানা টানাপোড়ন। ছেলের খাবার জোগাতে তাই দিশেহারা হয়ে পড়েন ছায়া বিবি। শুরু করেন অন্যের বাড়িতে ঝিঁয়ের কাজ। ঝিঁয়ের কাজ করে সংসার চালিয়ে দু’টি উন্নত জাতের ভেড়া কিনে পালতে শুরু করেন। দু’টি ভেড়া থেকে শুরু হয় ছায়া বিবির জীবন সংগ্রাম। এখন তার খামারে রয়েছে একশ ভেড়া। খামারে ভেড়া পরিচর্যা করেই দিন কাটে তার। খামার করেই একমাত্র ছেলে শেবাস্তিন মন্ডলকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ছেলে এখন একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। মা-ছেলের সংসারে সুখের কোনো কমতি নেই।
ছায়া বিবি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার পরিবারে এখন সাতজন সদস্য। সবাই আমার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ টাকার ভেড়া বিক্রি করি। এ থেকেই আমার সংসার চলে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভেড়া চড়িয়ে দিন ফুরাই। বছর শেষে যখন অনেক টাকার ভেড়া বিক্রি করি তখন আনন্দে আমার চোখে জল আসে। এই টাকার জন্য আমাকে একদিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে। অন্যের বাড়িতে কাজ করেছি। এখন আমার খামারে রয়েছে ছোট-বড় একশ ভেড়া। আমার কাজে সহায়তা করে আমার ভাই মায়া মন্ডল। তারও এখান থেকে কর্মসংস্থান হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমাকে সরকারিভাবে কোনো সহায়তা দেওয়া হয় না। সরকারি পশু ডাক্তাররাও আমার কোনোদিন খোঁজ নিতে আসেনি। বাড়ির পাশের এক গ্রাম্য পশু ডাক্তারকে দিয়ে ভেড়াগুলোর চিকিৎসা করানো হয়। সরকারি সহায়তা পেলে আরও বড় খামার গড়ে তোলার আশা তার।
বল্লভপুর গ্রামের শেরখান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছায়া বিবিকে জীবনে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অনেক সংগ্রাম করে আজ সে প্রতিষ্ঠিত নারী। বৃদ্ধা বয়সেও সে আজও ভেড়া পালন করছেন। তার কাছ থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ভেড়া কিনে পালতে শুরু করেছেন। তিনি ছায়া বিবিকে সরকারিভাবে সহায়তা করার দাবি করেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য বাবুল মল্লিক বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি ছায়া বিবির দুর্দিন। চার বছরে ভেড়া পালন তার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে সে। এখন ছায়া বিবির খামারে শতাধিক ভেড়া। সকাল আর সন্ধ্যায় ভেড়া নিয়ে রাস্তায় বের হলে দেখা যায় ছায়া বিবির ভেড়ার বহর। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমিও তাকে অনেকভাবেই উৎসাহ দিয়ে আসছি। ছায়া বিবিকে অনুকরণ করলে অনেকের সংসারে আসতে পারে আর্থিক স্বচ্ছলতা।
মেহেরপুর জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, জেলায় মোট ভেড়ার খামার রয়েছে ৫৮২টি। মোট ভেড়া পালন করা হচ্ছে ২৯ হাজার ২৭০টি।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডাক্তার মো. আবিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছরের দুটি ঈদে অন্যান্য পশুর তুলনায় ভেড়া পালনকারীরাও অনেক লাভবান হয়েছে। জেলায় মাংসের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন বাজারে মেহেরপুরের ভেড়ার অন্যরকম কদর রয়েছে। এবছরও ভেড়া পালনে খামারিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে মুজিবনগরের ছায়া বিবির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে তাকে সব সুযোগের আওতায় আনা হবে।
আকতারুজ্জামান/আরকে