ট্রেনে নাশকতার ঘটনায় ট্রাস্কফোর্সের অভিযান, দুই গ্রাম পুরুষ শূন্য
গাজীপুরের ভাওয়াল ও রাজেন্দ্রপুর রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী বন খড়িয়া এলাকায় দুর্বৃত্তরা রেললাইন কেটে ফেলায় ইঞ্জিনসহ ৭ বগি লাইনচ্যুত ও ট্রেন চালকসহ যাত্রী হতাহতের ঘটনায় মামলা হয়েছে। ঘটনার একদিন পর বৃহস্পতিবার দায়ের করা মামলার বাদী হলেন রেলওয়ে গণপূর্ত বিভাগের (পিডব্লিউডি) উপ-সহকারী প্রকৌশলী (রেল) মো. আশরাফুল আলম খান।
রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে থানা পুলিশেও ওসি ফেরদাউস আহমেদ বিশ্বাস মামলা দায়েরের তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, নাশকতা ও হত্যার অভিযোগ এনে অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে বৃহস্পতিবার অভিযান শুরুর খবর পেয়ে ট্রেন দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশের দুই গ্রাম অনেকটাই পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে। এলাকাবাসীর মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্কও কাজ করছে।
ট্রাস্ক ফোর্সের অভিযান, এলাকা পুরুষ শূন্য
র্যাব-১-এর গাজীপুর পোড়াবাড়ি ক্যাম্পে দায়িত্বপালনরত কোম্পানি কমান্ডার মেজর মো. ইয়াসির অরাফাত হোসেন জানান, ট্রেনের লাইন কেটে ট্রেনের বগি-ইঞ্জিন লাইনচ্যুতি এবং হতাহতের ঘটনায় জড়িতদের সনাক্তে পুলিশ, ২-প্লাটুন র্যাব, ৩ প্লাটুন বিজিবি, পুলিশ ও একজন ম্যাজিস্ট্রেট (শ্রীপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি- মো. আল মামুন) সহযোগে গঠিত ট্রাস্কফোর্স অভিযান পরিচালনা করছে।
বিজিবি’র -(গাজীপুর) ৬৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. রফিকুল ইসলাম জানান, জড়িতদের খুঁজতে এবং নাশকতার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের উৎস অনুসন্ধানে বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত ভাওয়াল গাজীপুর এবং গান্ধিবাড়ি দুই গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানকালে ওই এলাকায় অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ পাওয়া গেছে এবং বাড়ি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং নারী-শিশু ছাড়া অনেকটাই পুরুষ শূন্য ছিল। রেলওয়ের ওয়াচম্যানদের কাছ থেকে কিছু তথ্য নেওয়া হয়েছে। এলাকায় কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডারের দোকান পাওয়া গেছে। অভিযানকালে দুইটি অবৈধ গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির দোকানও পাওয়া গেছে। এসব দোকান অধিকতর তদন্ত করে দেখবে পুলিশ। আগামীকাল শুক্রবারও অভিযান চলবে।
ঘটনা তদন্তে কাজ করছে রেলওয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি। ঘটনাটি 'একটি নাশকতা ' এমন তথ্য ও উপাত্তকে এবং আলামতকে সামনে রেখেই তদন্ত চলছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশনের স্টেশন মাস্টার মো. হানিফ আলী জানান, দুর্ঘটনাস্থলের ৩০০ মিটার দূরে গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘১০’ লেখা একটি সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে, যাতে ওই এলাকা অতিক্রমের সময় ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি থাকে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ট্রেন খুবই স্বল্পগতিতে দুর্ঘটনাস্থল এলাকা অতিক্রম করছে। ক্ষতিগ্রস্ত লাইন মেরামত কাজ শেষ হলেও দুর্ঘটনাস্থলের রেললাইনের দুই পাশে পরে থাকা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ও রেলের কোচগুলো উদ্ধারে কাজ করছে। বিকেলে ক্ষতিগ্রস্ত কোচ ও ইঞ্জিন সরিয়ে নিতে দুটি রিলিফ ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ ফের শুরু করে। রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এ উদ্ধার কাজ চলছে।
এ দিকে ঘটনার তদন্তে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির সদস্যরা বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটির প্রধান হিসেবে রয়েছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শাহ ইমাম আলী রেজা। কমিটির সদস্যরা দীর্ঘক্ষণ ধরে ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথ পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা দুর্ঘটনাকবলিত মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে থাকা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
এ সময় তদন্ত কমিটির প্রধান শাহ ইমাম আলী রেজা সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সরেজমিন পরিদর্শন করছি। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসগুলো দেখব। ট্রেন সংশ্লিষ্ট যারা আছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সবার সঙ্গে কথা বলব। এরপর যথাযথ সময়ের মধ্যে কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত রিপোর্ট পেশ করব। তিন কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া দুপুর ৩টার দিকে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের গঠিত ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
নাশকতা ধরেই চলছে তদন্ত
বুধবার ভোরে রেললাইন কেটে ট্রেনে নাশকতা চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা মোহনগঞ্জ লাইনচ্যুত হয়। এ ঘটনায় এক রেলযাত্রী নিহত হন। নাশকতাকারীরা রেল লাইনের ২০ ফুট কেটে ফেলায় ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ৭টি বগি লাইনচ্যুত হয় বলে মনে করছেন পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় রেলওয়ে বিভাগের। এ ঘটনায় রেলওয়ে বিভাগের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িতদের সনাক্ত করতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসনের গঠিত ট্রাস্কফোর্স অভিযান পরিচালনা করছে বলে জানিয়েছেন বিজিবির গাজীপুর ৬৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. রফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ঘটনাটি নাশকতা ধরে ট্রাস্কফোর্স আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করছে। ঘটনাস্থলে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া গেছে। আমরা স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে সেই লক্ষ্যে একটি সমন্বিত ট্রাস্কফোর্স অভিযান পরিচালনা করছি। আমরা অপরাধীদের সনাক্ত করতে চেষ্টা করছি। তবে এখানে নাশকতা করতে বাইরের জেলার লোক আসেনি। এছাড়া গ্যাস সিলিন্ডারে দুটি কোথা থেকে এসেছে তার তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
র্যাব-১ এর পোড়াবাড়ী ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর ইয়াসির আরাফাত হোসেন বলেন, দুর্ঘটনার রহস্য উদঘাটনে এখনো কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। দুস্কৃতিকারীরা কয়জন ছিল, কীভাবে সিলিন্ডারের মাধ্যমে রেল লাইন কাটা হয়েছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তবে প্রাথমিকভাবে ঘটনাটি নাশকতা ধরেই আমাদের তদন্ত চলছে।
জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শহীদুল্লাহ হিরো বলেন, বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বনখড়িয়া এলাকায় ঢাকা ময়মনসিংহ রেল লাইনের মেরামত কাজ শেষ করে ট্রেন চলাচলের জন্য উপযোগী করা হয়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ভাওয়াল এক্সপ্রেস, বলাকা কমিউটার, দেওয়ানগঞ্জ কমিউটারসহ বেশ কয়েকটি ট্রেন ওই এলাকা দিয়ে চলাচল করে। কিন্তু দুর্ঘটনাস্থলের রেললাইনের দুই পাশে পড়ে থাকা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রসের লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ও ৬টি বগি দুপুরে পড়ে ছিল। বৃহস্পতিবার বিকেলে ক্ষতিগ্রস্ত বগি ও ইঞ্জিন সরিয়ে নিতে দুটি রিলিফ ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ ফের শুরু করে।
শিহাব খান/এমএএস