শীতে কাবু শ্রমজীবী মানুষেরা
‘সকালবেলা বাইরোত ব্যার হওয়া কষ্টকর। জারোতে সোগ কিছু সোরপোটা নাগি যায়। চাইরোপাকে খালি শীত পড়ছে। আর সইন্দা হোইলে তো জার হামাক জাপটে ধরে। এমন করিয়্যা হামার দিন যাওছে। আগের বছরের একটা কম্বল আছে, তাকে গায়োত মোড়েয়া আচু। তাও মনে হয় জার কমে না।’
কথাগুলো বলছিলেন রংপুর নগরীর হাজীপাড়া টার্মিনাল রোড এলাকার লাইলী বেগম। মঙ্গলবার সকালে (১২ ডিসেম্বর) তার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়।
ষাটোর্ধ্ব বয়সী লাইলী বেগম পেশায় একজন ইমারত শ্রমিক। তিনি প্রতিদিন ভোরে কাজের সন্ধানে বের হন। তবে গত দুই-তিন দিন ধরে ঘন কুয়াশার কারণে তিনি কাজে যাচ্ছেন না।
এদিকে নগরীর শাপলা চত্বর এলাকায় বেশ কয়েকজন ভবঘুরে মানুষের দেখা মেলে। যাদের বেশিরভাগেরই রাতের বেলায় জায়গা হয় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। কেউবা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় থাকেন। এসব ছিন্নমূল মানুষেরা শীতের সময় জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠনের দেওয়া শীতবস্ত্রে শীত নিবারণের চেষ্টা করে থাকেন। তবে এখন পর্যন্ত তাদের কেউই কোনো শীতবস্ত্র পায়নি বলে জানান।
মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত রংপুর নগরীর হাজীপাড়া, শাপলা চত্বর, লালবাগ, বাবুখাঁ, দর্শনা ও টার্মিনাল রোড এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শীতের কারণে রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি খুবই কম। তবে কেউ কেউ জরুরি কাজে বের হলেও পরনে ছিল মোটা কাপড়।
লালবাগ কলেজপাড়া এলাকায় খড়কুটো জ্বালিয়ে শীতের তীব্রতা নিবারণের চেষ্টায় ব্যস্ত মশিউর, মামুন ও রজব আলীসহ আরও অনেকে। তারা কয়েকদিন ধরে সকালবেলা এভাবেই খড়কুটো জ্বালিয়ে হাত-পা গরম করে নেন। পরে কাস্তে-কোদাল আর লাঙল নিয়ে নেমে পড়েন খেত-খামারে।
কৃষিশ্রমিক রজব আলী বলেন, বাড়িত তেমন গরম কাপড় নাই। গত বছর একান জাম্পার (জ্যাকেট) পাচনু। এবার তো হামার এত্তি এ্যালাও কায়ো শীতবস্ত্র দেয় নাই। সকালে পুরাতন জাম্পার পরি বাইরোত ব্যারাইলেও জার বুজা যায়। কষ্ট হয় বাহে।
রংপুরে শীতের সকালে এসব ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। কোথাও কোথাও সড়কে, অলিগলি আর খোলা জায়গায় খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চললেও ঘরে বাইরে উষ্ণতা পেতে বেশিরভাগ মানুষের শরীরে মোটা কাপড় জড়িয়েছেন। অগ্রহায়ণের শেষ বেলায় এমন ঘন কুয়াশার ঘোরে বিপাকে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষেরা। ঘরের বাইরে বের হওয়া এসব মানুষদের কাছে এ যেন মাঘের শীত।
হিমেল হাওয়ার সঙ্গে ঝিরঝির জলফোঁটায় ভিজে গেছে প্রকৃতির বুক। কুয়াশাময় সকাল থেকেই খেতে খামারে কাজে ব্যস্ত কৃষাণ-কৃষাণি। তবে ছিন্নমূল ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনের পাশাপাশি গবাদি পশুপাখি টের পাচ্ছে শীতের তেজ।
এদিকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হতে দেখা যায়। সূর্যের দেখা মিললেও আলোর তেমন ঝলকানি নেই। সোমবারের তুলনায় তাপমাত্রা কিছুটা কমে এসেছে। শহর থেকে একটু দূরে গ্রামে থাকা ছিন্নমূল, অসহায় ও দরিদ্র পরিবারগুলোর পাশাপাশি চরাঞ্চলের প্রান্তিক মানুষেরা শীতবস্ত্রের অভাবে দুর্ভোগে পড়েছেন বেশি। অনেকের শীতবস্ত্র কেনার মতো সামর্থ্যও নেই। তাই খড় ও শুকনা পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন তারা।
এদিকে শীতজনিত নানা রোগ নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উত্তরাঞ্চলের বহু মানুষ প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসছেন। এর মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধা বয়সের মানুষ বেশি।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত রংপুর জেলায় তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ১৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রংপুর বিভাগের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা সর্ব উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ের তেতুঁলিয়ায় ১২ দশমিক শূন্য। রংপুরে আগামী দুই-তিন তাপমাত্রা ওঠানামা করতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি আরও জানান, আজ ভোর ৬টায় কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ১৩ দশমিক ৮, দিনাজপুরে ১৩ দশমিক ৩, নীলফামারীর সৈয়দপুরে ১৩ দশমিক ২ এবং ডিমলায় ১৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
এ ব্যাপারে রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান জানান, ৪৫ হাজার কম্বল রংপুর নগরীসহ জেলার আট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পৌঁছে গেছে। শিগগিরই কম্বল বিতরণ শুরু হবে। এছাড়া আরও ২৫ হাজার পিস কম্বলের চাহিদা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে