এই শীতে ঘুরে আসুন নিঝুম দ্বীপ
মায়াবী হরিণ, বিশাল কেওড়া বন আর নরম বালুর মাঝে অপরূপ সৈকত নিঝুম দ্বীপ। সাগরের জলরাশি আর ঢেউয়ের গর্জনের সঙ্গে হিমেল হাওয়ায় মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা লীলাভূমি এ দ্বীপে সৃষ্টিকর্তা সব রূপ ঢেলে দিয়েছেন। প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসু পর্যটক নিঝুম দ্বীপে ঘুরতে আসেন।
নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠা প্রাণ প্রকৃতির নৈসর্গিক দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের কোলে বালুচরবেষ্টিত ছোট্ট সবুজ ভূখণ্ড এটি। অগণিত শ্বাসমূলে ভরা কেওড়া গাছ দেয়াল বানিয়েছে দ্বীপের চারদিকে। পূর্বাকাশে জ্বলজ্বলে সূর্যের আলো সাগরের ছোট ছোট ঢেউগুলোয় ঝলমল করছে, সৈকতের কেওড়া বন পেরিয়ে অর্ধে হাওয়া এসে লাগছে গায়ে। নীল জলে সাতার কাটছে ছোট-বড় ট্রলার। সৈকত, কেওড়া বন, পাখি-প্রকৃতি, গ্রাম সেবকিছু একত্রে দেখতে চাইলে যে কোনো পর্যটক যেতে পারেন নিঝুম দ্বীপ।
নিঝুম দ্বীপ নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার অন্তর্গত। ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার দ্বীপটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৩ সালে দ্বীপটি জাহাজমারা ইউনিয়ন থেকে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র ইউনিয়নের মর্যাদা লাভ করে। ১৯৫০-এর দশকে এ দ্বীপটি জেগে ওঠে। ক্রমে পলি জমে দ্বীপটি আজকের আকার ধারণ করে। ১৯৭৪ সালের দিকে বন বিভাগ এই দ্বীপের উত্তর অংশে ব্যাপকভাবে বনায়ন করে, ফলে ১৫ বর্গমাইল দ্বীপটির বেশির ভাগই পরিণত হয়েছে অভয়ারণ্যে। শুরুতে ‘চর ওসমান’ নামে পরিচিত হলেও ১৯৭৯ সালে সাবেক মন্ত্রী আমিরুল ইসলাম খান এই দ্বীপের নাম দেন ‘নিঝুম দ্বীপ’।
জানা যায়, ওসমান নামের একজন তার মহিষের বাথান নিয়ে প্রথম এখানে বসত গড়েন। তাই তার নামেই চর ওসমান নামকরণ হয়। ১৯৫০ সালের দিকে জনবসতি গড়ে ওঠে। দ্বীপের মাটি চিকচিক করায় জেলেরা নাম দিয়েছেন বালুর চর। দ্বীপটিতে বালুর ঢিবি বা টিলার মতো ছিল বিধায় স্থানীয় লোকজন একে বাইল্যার ডেইল বা বাইল্লারচর বলেও ডাকত। নিঝুম দ্বীপে রয়েছে ৯টি গুচ্ছ গ্রাম। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ জনপদ।
নিঝুম দ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। দ্বীপের ৭০ ভাগ মানুষ মৎস্যজীবী ও ৩০ ভাগ কৃষিজীবী। বাংলাদেশ বন বিভাগ সত্তরের দশকে নিঝুম দ্বীপে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে চার জোড়া হরিণ ছাড়া হয়। দ্বীপটি বর্তমানে হরিণের অভয়ারণ্য। ১৯৯৬ সালের হরিণশুমারি অনুযায়ী হরিণের সংখ্যা ২২ হাজার। যদিও সময়ের হিসেবে দিন দিন হরিণের সংখ্যা কমে আসছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, হরিণের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। কুকুর বনের হরিণ ধরে ধরে খাচ্ছে। বর্ষায় কিছু হরিণের খুরারোগ হয়। সে সময় হরিণগুলোর হাঁটতে কষ্ট হয়। এ ছাড়া দ্বীপে হরিণের জন্য সুপেয় মিঠাপানির অভাব রয়েছে। বড় জোয়ার হলেও কিছু হরিণ মারা যায়।
দর্শনীয় স্থানসমূহ
কমলার দ্বীপ : সেখানের কমলার খালে অনেক ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। এছাড়া আশপাশের দ্বীপগুলো সুন্দর। পুরো দ্বীপটা হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখা যাবে।
চৌধুরী খাল ও কবিরাজের চর : এ জায়গার অপরূপ সৌন্দয্য দেখতে চাইলে যেতে হবে বিকেলে সন্ধ্যার আগে, চৌধুরীর খাল নেমে ঘণ্টা খানেক হাঁটলেই বনের মধ্যে হরিণের পালের দেখা পেতে পারেন।
চোয়াখালি ও চোয়াখালি সমুদ্র সৈকত : চোয়াখালিতে গেলে খুব সকালে হরিণ দেখা যায়। মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে খুব সকালে হোটেল থেকে বেড়িয়ে হরিণ দেখতে পারবেন।
নামার বাজার সমুদ্র সৈকত : নামার বাজার থেকে হেঁটে যেতে ১০ মিনিট সময় লাগে। এখান থেকে সূর্যোদয ও সূর্যাস্ত দেখতে পাবেন, এখানে বারবিকিউ করে মজা পাবেন।
দমার চর : এই চরের দক্ষিণ দিকে নতুন একটি সমুদ্র সৈকত আছে যাকে বলে ‘কুমারী দ্বীপ’। খুব সকালে এখানে অনেক নাম না জানা পাখির দেখা মেলে।
যেভাবে যাবেন নিঝুম দ্বীপে
ঢাকা থেকে নদী ও সড়ক পথে নিঝুমদ্বীপে যাওয়া যায়। সবচেয়ে সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা হল ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে হাতিয়া, সেখান থেকে নিঝুমদ্বীপ। ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন বিকাল সাড়ে ৫টায় একটি মাত্র লঞ্চ হাতিয়ায় তমুরদ্দী ঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। গন্তব্যে পৌঁছতে পৌঁছতে পরদিন সকাল ৯টা বেজে যাবে। তমুরদ্দী ঘাট থেকে ঢাকার ফিরতি লঞ্চ ছাড়ে দুপুর সাড়ে ১২টায়। লঞ্চের ডেকে, সিঙ্গেল কেবিন ও ডাবল কেবিনে ভাড়া পড়বে যথাক্রমে ৫৫০ টাকা, এক হাজার ২০০ টাকা ও দুই হাজার ২০০ টাকা।
তমরুদ্দি ঘাট থেকে সিএনজি অটোরিকশায় বা মোটরসাইকেলে মোক্তারিয়া ঘাট পৌঁছা যাবে। বাকি পথটা একইভাবে পাড়ি দিতে হবে। তবে তমরুদ্দি ঘাট থেকে সরাসরি নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার পর্যন্ত জলপথটা পাড়ি দেওয়ার আরেকটি উপায় আছে। তমরুদ্দি ঘাট থেকে কিছু মাছ ধরার ট্রলার সরাসরি নামার বাজার যায়। এগুলোতে উঠতে হলে সকাল ১০টার আগেই ঘাটে উপস্থিত থাকতে হবে। আর জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এ ছাড়া এখান থেকে ট্রলার রিজার্ভ করেও সরাসরি নামার বাজার যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে সেক্ষেত্রে তিন হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া পড়তে পারে।
বাসে চড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকার সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে নোয়াখালীর সোনাপুর পর্যন্ত যেতে হবে। বাসের ধরনের ওপর ভিত্তি করে এসব বাসে ভাড়া পড়তে পারে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। সোনাপুর থেকে চেয়ারম্যান ঘাট যাওয়ার জন্য বাস অথবা সিএনজি চালিত অটোরিকশা করে যাওয়া যায়। পুরো একটা সিএনজি রিজার্ভ করতে খরচ পড়বে ৫০০ টাকা। বাসে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৬০ টাকা করে।
চেয়ারম্যান ঘাট থেকে হাতিয়া যাওয়ার জন্য আছে ট্রলার, সি-ট্রাক, ও স্পীড বোট। যেগুলোতে জনপ্রতি ভাড়া পড়তে পারে যথাক্রমে ২৫৫ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। এই জলযানগুলো নামিয়ে দিবে হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে। এখানে মনে রাখা উচিত যে, চেয়ারম্যান ঘাট থেকে সি-ট্রাক ছাড়ে প্রতিদিন সকাল ৮টায়। আর নলচিরা থেকে চেয়ারম্যান ঘাট আসার ফিরতি সি ট্রাক ছাড়ে সকাল ১০টায়।
নলচিরা ঘাট থেকে স্থলপথে সিএনজি অটোরিকশায় বা মোটরসাইকেলে মোক্তারিয়া ঘাটে পৌঁছা যাবে। বাকি পথটা একইভাবে পাড়ি দিতে হবে। মোটরসাইকেলে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা ভাড়ায় সর্বোচ্চ দুইজনকে মোক্তারিয়া ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এরপর মোক্তারিয়া ঘাট থেকে ট্রলারে চেপে জনপ্রতি ৪৫ টাকা ভাড়ায় পৌঁছা যাবে নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ঘাটে।
ট্রেন ভ্রমণ করতে হলে ঢাকার কমলাপুর থেকে উঠে নেমে যেতে হবে সর্বশেষ স্টেশন সোনাপুরে। এখানে সময় লাগবে প্রায় ছয় ঘণ্টা আর ট্রেনের শ্রেণিভেদে ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ২৩০ থেকে ৫০০ টাকা। এরপরে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার রাস্তাটা একই। তবে নতুন করে চেয়ারম্যান ঘাট থেকে সরাসরি ট্রলার দিয়ে যাতায়াত শুরু হয়েছে। এতে ভোগান্তি কম হলেও পাড়ি দিতে হয় লম্বা সময়।
যেখানে থাকবেন
নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ও নামার বাজার সৈকতের কাছেই ভালো মানের কয়েকটি রিসোর্ট আছে। এগুলোতে জনপ্রতি এক হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা খরচে বিভিন্ন ক্যাটাগরির রুম পাওয়া যাবে। ছুটির দিনে গেলে আগে থেকে বুকিং করে যাওয়া সুবিধাজনক। তবে চাইলে সেখানে গিয়েও পছন্দমত রিসোর্ট ঠিক করতে পারবেন। তারমধ্যে জেলা পরিষদের ডাক বাংলো, বন বিভাগের রেস্ট হাউজ, অবকাশ হোটেল, হোটেল শাহিন, হোটেল সোহেল, মসজিদ বোর্ডিং, নিঝুম ড্রিম প্যান্ড রিসোর্ট ইত্যাদি অন্যতম।
যেখানে খাবেন
খাবার হোটেলের মধ্যে নিঝুমদ্বীপের নামার বাজারের হোটেলগুলো বিখ্যাত। এখানে বিভিন্ন রকমের সামুদ্রিক মাছ ও চিংড়ি খেতে পারেন। এখানকার মহিষের দই বিখ্যাত। শীতের সময় প্রচুর খেজুরের গুড় পাওয়া যায়।
হাতিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুরাইয়া আক্তার লাকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাতিয়া উপজেলার নিঝুমদ্বীপসহ যতগুলো পর্যটন কেন্দ্র আছে সবগুলোই শীতের সময়ে প্রচুর ভিড় হয়। আমরা প্রতিটি স্পটেই নিরাপত্তার জন্য কাজ করছি। পর্যটকরা যেনো নিরাপদে থাকতে পারে, ঘুরতে পারে আমরা সকল বিভাগ একসঙ্গে কাজ করছি। মানসম্মত হোটেল রিসোর্টে যেনো নিরাপত্তার সঙ্গে থাকতে পারে সেজন্যও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া আছে।
নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস ঢাকা পোস্টকে বলেন, শীতের সময়ে নিঝুমদ্বীপে প্রচুর মানুষ ঘুরতে আসে। এখানে আরও উন্নত মানের হোটেল দরকার। আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি শতভাগ নিরাপত্তা দিতে। যেনো নির্বিঘ্নে মানুষ এখানে থাকতে পারে, সময় কাটাতে পারে। এই জন্য আমরা আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি।
এএএ