স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বছরে আয় ৮ কোটি টাকা, নেই ইলেকট্রনিক সামগ্রী
গত ১৫ বছরে মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের আয় বেড়েছে ৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকার বেশি। তার আয় বেড়েছে সাড়ে ১১ গুণ। অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১০ গুণেরও বেশি। বর্তমানে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কোনো ইলেকট্রনিক সামগ্রী নেই। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামার তথ্য এবং এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দেওয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন, মানিকগঞ্জ পৌরসভা ও সাটুরিয়া উপজেলা নিয়ে মানিকগঞ্জ-৩ সংসদীয় আসন গঠিত। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ সাল এবং এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বচান নিয়ে টানা চারবার আওয়ামী লীগ থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন জাহিদ মালেক। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস নির্বাচিত হন এবং স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা তৃতীয় বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান জাহিদ মালেক।
এবারের হলফনামায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী পেশা হিসেবে ‘মন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ উল্লেখ করেছেন। আর ২০০৮ সালে হলফনামায় পেশা হিসেবে ‘ব্যবসা’ এবং সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ও বাংলাদেশ থাই অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড এই দুটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান উল্লেখ করেছিলেন। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই।
২০০৮ সাল থেকে ২০২৩
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট বা দোকান বা অন্যান্য ভাড়া, ব্যবসা, প্লট, এগ্রো ফার্ম, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক আমানত, ডিভিডেন্ড এবং অন্যান্য (এমপির সম্মানী ভাতা) বাবদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাৎসরিক আয় বর্তমানে ৮ কোটি ২৯ লাখ ৯৭ হাজার ২৫ টাকা। যা ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় ছিল ৭১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯১ টাকা। এই হিসেবে গত ১৫ বছরে তার বাৎসরিক আয় বেড়েছে ৭ কোটি ৫৮ লাখ ৬২ হাজার ৩৩৪ টাকা। অর্থাৎ সংসদ সদস্য থেকে প্রতিমন্ত্রী, এরপর মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে গত ১৫ বছরে তাঁর বাৎসরিক আয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৬৩ গুণ।
বেড়েছে অস্থাবর সম্পদও। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা এবং ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১০ দশমিক ৩৭ গুণ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নগদ ৬৪ লাখ ১১ হাজার ৮৩৫ টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা ৬৭ হাজার ৯৯৬.৬২(ইএসডি), ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ১৫ কোটি ৫৭ লাখ ৯৯ হাজার ৪৬৮ টাকা, বন্ড ও ঋণপত্র, স্টোক একচেঞ্জে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ার বাকি ব্যবসার মূলধনসহ, ব্যক্তি ব্যবসার মূলধনসহ ৪৯ কোটি ৪৭ লাখ ৭২ হাজার ৫৬ টাকা, যানবাহন বাবদ ২ কোটি ২৪ লাখ ৮৬ হাজার ৪৭৭ টাকা, আসবাপত্র ৭০ হাজার এবং অন্যান্য ১ কোটি ৬৩ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৮ টাকাসহ তার অস্থাবর সম্পদের মোট আর্থিক মূল্য ৭০ কোটি ৩৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬১ টাকা।
যা ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামার তথ্য অনুযায়ী ছিল ৬ কোটি ৭৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫৭ টাকা। এই হিসাবে গত ১৫ বছরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য বেড়েছে ৬৩ কোটি ৫৫ লাখ ১৩ হাজার ৬০৪ টাকা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের কোনো ইলেকট্রনিক সামগ্রী নেই। এটি অনেকের কাছে অবিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হলেও এটিই সত্য। কারণ এবার অর্থ্যাৎ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। অথচ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী তার ১ লাখ টাকা মূল্যের মূল্যমান ইলেকট্রনিক সামগ্রী ছিল। এ ছাড়াও ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী তার কোনো ইলেকট্রনিক সমাগ্রী ছিল না।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী জাহিদ মালেকের নামে অকৃষি জমির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৫ কাঠা এবং তার স্ত্রী সাবানা মালেকের নামে ২ দশমিক ৫ কাঠা জমির একটি প্লট ছিল। এ ছাড়া ৫৩ দশমিক ৪ শতক জমিতে ১১ তলা আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবন এবং বাড়ি ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। যার আর্থিক মূল্য ছিল ৩ কোটি ৬১ লাখ ৬ হাজার ২২ টাকা। এ ছাড়া যৌথ মালিকানায় ৪০ বিঘা কৃষি জমি ছিল। এখন এই স্থাবর সম্পদের পরিমাণ অপরিবর্তনীয় রয়েছে। তবে স্ত্রীর নামে ২ দশমিক ৫ কাঠার ওই জমি এবার নির্ভরশীলদের নামে স্থানান্তর করা হয়েছে। যৌথ মালিকানার ৪০ বিঘা কৃষিজমি এবার নির্ভরশীলদের নামে রয়েছে বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্ত্রীর সম্পদ কমেছে। হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্ত্রী শাবানা মালেকের সামান্য অস্থাবর সম্পদ কমেছে। ২০০৮ সালে তার স্ত্রীর ৩৯ লাখ ৮৬ হাজার ৩০০ টাকার বন্ড বা ঋণপত্র ছিল। এবারের হলফনামায় তা উল্লেখ নেই। তবে ১৫ বছরে সাবানা মালেকের ৫ ভরি স্বর্ণ বেড়েছে। অর্থাৎ বর্তমান বাজার দরে ৫ ভরি স্বর্ণের দাম প্রায় ৫ লাখ টাকা। সেই হিসেবে গত ১৫ বছরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্ত্রীর প্রায় ৩৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ কমেছে। কিন্তু ২০০৮ সালে জাহিদ মালেকের ওপর নির্ভরশীলদের ২৫ ভরি স্বর্ণ থাকলেও এবারের হলফনামা তা উল্লেখ নেই। অর্থাৎ নির্ভলশীলদের ওই পরিমাণ স্বর্ণ কমেছে।
ঋণ বেড়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। এবারের হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক লি. এবং সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ও কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের কাছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ১ কোটি ৭৩ লাখ ৭৭ হাজার ৭৯ টাকা ঋণ রয়েছে। যা ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্যানুযায়ী ঋণের পরিমাণ ছিল ২৩ লাখ ৫৩ হাজার ২৮০ টাকা। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ১ কোটি ৫০ লাখ ২৩ হাজার ৭৯৯ টাকার ঋণ বা দায় বেড়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকসহ জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা রেহেনা আকতারের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন ৯ জন প্রার্থী। তবে যাচাই-বাছাই শেষে দুইজন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা। এই আসনে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সাতজন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন। আগামী ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ছয়টি রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে নির্বাচনের মাঠে ভোটের লড়াই করবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
আরএআর