ঝিনাইদহে বেড়েছে সবজির উৎপাদন, কৃষকের মুখে হাসি
ভোরের সূর্য ওঠার আগেই কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত সবজি নিয়ে আসেন হাটে। ব্যসায়ীরাও অপেক্ষা করতে থাকেন ভালো মানের সবজি কেনার আশায়। মৌসুমের প্রথমে সবজির বাজার ভালো ছিল। বর্তমানে সবজির উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বাজার কিছুটা কম হলেও কৃষকেরা খুশি।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা, হরিণাকুন্ডু, চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জ এলাকার কৃষকেরা তাদের শীতকালীন সবজি উৎপাদন করে নিয়ে আসেন বাজারে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ডাকবাংলা বাজারের ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা মহাসড়কের দুই পাশ জুড়ে বসে এই সবজির বাজার। সপ্তাহে রোববার ও বৃহস্পতিবার বসে এই হাট। হাটে আসা ফুলকপি, পাতাকপি, মুলা, বেগুন, লাউ, শিম, পালংশাক, লালশাকসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি, ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে যায়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, রাজশাহী, জামালপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
সরোজমিনে ডাকবাংলা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ভোর সকালে ঘনকুয়াশা ভেদ করে কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত শীতকালীন সবজি নিয়ে আসছেন বাজারে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, বেগুনসহ সব ধরনের সবজিই এসেছে। ঢাকা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, খুলনার পাইকারি ব্যবসায়ীরা আসছে এই বাজারে সবজি কিনতে। ব্যসায়ীরা কৃষকদের থেকে দর-দাম করে সবজি ক্রয় করছেন। যার মধ্যে ফুলকপি পাইকারি বিক্রয় হচ্ছে ৮শ থেকে সাড়ে ৮শ টাকা মণ। বেগুন প্রকারভেদে ৭শ থেকে ১ হাজার টাকা মণ, লাউ প্রতি পিস ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। শিম প্রতি কেজি ২৫ থেকে ৩০ টাকা, মুলা ৪ থেকে ৫ টাকা কেজি, বাঁধাকপি ৭০০ টাকা মণ। শীতকালীন সবজির মধ্যে শিম ও লাউয়ের দাম তুলনামূলক বেশি। সবজির বাজারকে ঘিরে ১৫০ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে বলে জানা গেছে। ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে ক্রয়-বিক্রয় প্যাকেজিং ও দেশের বিভিন্নস্থানে গাড়িতে করে সবজি পৌঁছানোর কাজ।
হরিণাকুন্ডু থেকে আসা কৃষক মনিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি এবছর ১০ শতাংশ জমিতে লাউ ও ২০ শতাংশ জমিতে বেগুন চাষ করেছেন। প্রথম থেকেই লাউয়ের বাজার ভালো পেয়েছেন। বেগুন প্রথমে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা পাইকারি বিক্রয় করলেও বর্তমানে দাম কম। তবে বর্তমানে চাষে কোনো লোকসান নেই। সবজি চাষ করে ভালো লাভবান হয়েছেন তিনি।
চুয়াডাঙ্গা সরোজগঞ্জ এলাকার কৃষক মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে জানান, এ বছর ৭বিঘা জমিতে শীতকালীন সবজি ফুলকপি চাষ করেছেন। প্রথমে ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। আজকের বাজারে ৩০ টাকা কেজি বিক্রয় করেছেন। তিনি জানান, অন্যান্য বাজারের তুলনায় ডাকবাংলা বাজারে দূর থেকে ব্যবসায়ীরা আসে সবজি কিনতে। এখান থেকে তাদের উৎপাদিত সবজি দেশের বিভিন্নস্থানে পৌঁছে যায় সহজেই। রাসায়নিক সার ও কিটনাশকের দাম বেশি হলেও গত বছরের তুলনায় এবছর সবজি চাষে সফলতা পেয়েছেন।
সাধুহাটি এলাকার বেগুন চাষি ওমর আলী ঢাকা পোস্টকে জানান, ২১ কাঠা জমিতে বেগুন চাষ করেছেন তিন। এখন পর্যন্ত সাড়ে তিন লাখ টাকার বেগুন বিক্রয় করেছেন। যা অন্য ফসলের তুলনায় অনেক বেশি লাভবান হয়েছেন। শীতে বেগুন উৎপাদন বেশি যার কারণে বাজারে বেগুন বেশি আসছে, দামটাও একটু কম।
সবজি ব্যবসায়ী রনি ঢাকা পোস্টকে জানান, তিনি ডাকবাংলা বাজারে প্রতিহাটে ১২ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকার সবজি কেনেন। ১২ থেকে ১৫ জন ব্যবসায়ী এই বাজার থেকে সবজি কেনেন। সেগুলো ঢাকা, রাজশাহী, জামালপুর জয়পুরহাটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠান।
গত বছরের তুলনায় এবছর সবজির বাজার ভালো। বর্তমানে সবজি উৎপাদন বেশি, যার কারণে দাম কিছুটা কমেছে।
সবজি ব্যবসায়ী রিপন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরোজগঞ্জ, দশ-মাইল ও ডাকবাংলা বাজারে সবজির ব্যবসা করেন তিনি। অন্যান্য বাজারের তুলনায় ডাকবাংলা বাজারে সবজির আমদানি বেশি। কৃষেকরা মাঠ থেকে সবজিগুলো সরাসরি বাজারে নিয়ে আসে। একারণে কৃষকদের থেকে সরাসরি সবজি কিনতে পারেন। আবার এই বাজারে ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তাটাও অনেক ভালো। যার কারণে ব্যবসা করতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না।
ডাকবাংলা বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও সাধুহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী নাজির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাধুহাটি, সাগান্না, হলিধানী, মধুহাটি, হরিণাকুন্ডু উপজেলার দৌলতপুর, কাপাশাটিয়া, চুয়াডাঙ্গা জেলার কুতুবপুর ও সরোজগঞ্জ ইউনিয়নের মাঠে কৃষকের উৎপাদিত সবজি আসে আমাদের বাজারে। দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরাও আসে সবজি কিনতে। সবমিলিয়ে প্রতি হাটে ১২ থেকে ১৫ টি ট্রাকে লোড করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সবজি যায় এখান থেকে। হাট থেকে ২ কোটি টাকার বেশি সবজি ক্রয়-বিক্রয় হয়। বাজারে সবজি ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্র করে ১৫০ জনের বেশি লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। এতে এলাকার অনেকের বেকারত্ব দূর হয়েছে।
তিনি বলেন, বাজারে ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার কোনো সমস্যা নেই। যার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন সবজি কিনতে। বর্তমানে সবজির উৎপাদন ও দামটাও ভালো যার কারণে কৃষকেরা লাভবান হচ্ছে।
ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আজগর আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবছর আবহাওয়া ভালো থাকায় সবজির উৎপাদন ভালো হয়েছে। আবার অন্যান্য বছরের তুলনায় দামও ভালো পেয়েছে কৃষকেরা।
এবছর ফুলকপি বাঁধাকপি, মূলা, বেগুন, লাউ, শিম, পালনশাক, লালশাকসহসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করেছেন কৃষকেরা। জেলায় ১০ হাজার ৮শ ২৪ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির চাষ হয়েছে। যার মধ্যে ঝিনাইদহ সদর উপজেলাতে ২ হাজার ২শ হেক্টর, কালীগঞ্জে ১ হাজার ২শ হেক্টর, কোটচাঁদপুর ১ হাজার ২শ ১৪ হেক্টর, মহেশপুর ১ হাজার ৭শত ৫০ হেক্টর, হরিণাকুন্ডুতে ৮শ ১০ হেক্টর এবং শৈলকুপায় ৩ হাজার ৬শত ৫০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ হয়েছে। চলতি মৌসুমে সবজির চাষ আরও বাড়বে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন/আরকে