আজও ঘুমহীন রাত কাটে অনেক শ্রমিকের
দেশের পোশাক খাতের জন্য বিভীষিকাময় এক দিন আজ। ১১ বছর আগে আজকের এই দিনে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তাজরীন ফ্যাশন নামের পোশাক কারখানায় আগুন লেগে পুড়ে অঙ্গার হন ১১২ জন শ্রমিক। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরও ৬ জন।
শ্রমিকদের বাঁচার আকুতি আর নিহতদের স্বজন ও আহতদের কান্নায় সেদিন ভারী হয়ে উঠেছিল আশুলিয়ার আকাশ। সেই দিনের কথা ভেবে আজও ঘুমহীন কাটে আহত অনেক শ্রমিকের রাত।
ওই ঘটনায় আহত হন প্রায় ২ শতাধিক শ্রমিক। জীবন বাঁচাতে বিভিন্ন তলা থেকে লাফও দেন কয়েকজন। এভাবে অনেকেই প্রাণে বেঁচে গেলেও এখন পঙ্গু হয়ে জীবনযাপন করছেন তারা।
বেদনাবিধুর ২৪ নভেম্বর এলেই নিহতদের শ্রদ্ধা জানাতে সেই পুড়ে যাওয়া ভবনটির সামনে সমাবেত হন নিহতের স্বজন, আহত শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।
ঘটনার দিন ২৪ নভেম্বরের কথা মনে করে কেঁদে ফেলেন আহত শ্রমিক নূরনাহার। তিনি বলেন, সেদিনের কথা মনে হলেই আমার কলিজা ফেটে যায়। সেদিন আমি চার তলা থেকে লাফ দিয়েছিলাম। এরপর আমি কিছুই বলতে পারি না। পরে শুনি আমাকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়। এখন আমি কোনো কাজকর্ম করতে পারি না। আমরা গ্রাম থেকে এসে একটু ভালো থাকার আশায় পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের সারাজীবনের জন্য নেমে এলো কষ্টের পাহাড়।
সেদিন বোন, ভগ্নিপতি, ভাগিনা ও ভাগিনার বউকে হারিয়েছেন আহত শ্রমিক রেহানা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার দিন আমি ভয়ে স্যাম্পল রুমে যাই। সেখানে যাওয়ার পর আমি লাফ দিয়েছি, না কি করেছি আমি জানি না। তিনদিন পর আমার জ্ঞান ফিরলে দেখি হাসপাতালে। হাসপাতালেই শুনি আমার বোনের পুরো পরিবার আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে। পরে ওদের লাশও আমরা খুঁজে পাইনি। প্রায় ১ মাস পরে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি তাদের জুরাইন কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। আমরা স্বজন হারিয়েছি, নিজে কর্মক্ষমতা হারিয়েছি কিন্তু আমাদের জন্য কেউ কোনো সহায়তা দেয়নি। যেটুকু পেয়েছি তা চিকিৎসা করতেই ব্যয় হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কর্মক্ষমতা হারিয়ে এখন আমাদের না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। অনেক শ্রমিক নেতা আমাদের কথা বলে টাকা আত্মসাত করেছে। শ্রমিক নেতাদের সন্তানরা বিদেশে লেখাপড়া করে আর আমরা না খেয়ে থাকি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাই পুরো বিষয়টি তদন্ত করা হোক। আমাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ করার অনুরোধ জানাই।
আহত শ্রমিকদের প্রায় ৪০ জন এখনও আগুনে পুড়ে যাওয়া জরাজীর্ণ ভবনের পাশেই বসবাস করছেন ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের আশা নিয়ে। আহত শ্রমিক আনিস বলেন, আমরা কর্মক্ষমতা হারিয়ে আজও ক্ষতিপূরণের আশায় তাজরীনের পাশেই আছি। কিন্তু ১১ বছরেও আমরা ক্ষতিপূরণ পেলাম না। আমরা আশা হারাইনি। আমরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে টানা তিন মাস অবস্থান কর্মসূচি করেছি। শ্রমিক নেতারাসহ শ্রম প্রতিমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের বার বার ঘোরাচ্ছেন শ্রমিক নেতারা।
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য লীগের সাধারণ সম্পাদক সারোয়ার হোসেন বলেন, দেশের পোশাক খাতের ইতিহাসে তাজরীন ট্রাজেডি অন্যতম। এ দুর্ঘটনায় যা অনুদান এসেছিল তার সুষম বণ্টন হয়নি। এখনও অনেক শ্রমিক আহতাবস্থায় অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। আমরা দাবি করছি তাজরীন ফ্যাশনের ভবনটি সংস্কার করে আহত শ্রমিকদের পুনর্বাসন কিংবা শ্রমিকদের জন্য একটি হাসপাতাল নির্মাণের। এ ছাড়া এতো শ্রমিক নিহতের ঘটনা তদন্ত করে মামলার কার্যক্রম বেগবানের আহ্বান জানাই। প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দ্রুত নিশ্চিতের দাবি জানাই।
মাহিদুল মাহিদ/এনএফ