সিডরে দুই মেয়ে হারানোর কষ্ট এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন বাবা মতি মুন্সি
আজ থেকে ঠিক ষোল বছর আগে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলে আঘাত হেনেছিল এক ভয়াবহ সাইক্লোন সিডর। সেই ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে সারাদেশে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। কয়েক হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারান। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, বাগেরহাট ঝালকাঠিসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছিল যে সব অঞ্চলগুলোতে তার মধ্যে পটুয়াখালীও একটি। আজ সেই ভয়াল ১৫ নভেম্বর।
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার ৬নং মহিপুর সদর ইউনিয়নের সুধীরপুর গ্রামের বাসিন্দা মতি মুন্সি (৭০)। দুই ছেলে এবং পাঁচ মেয়ের সংসার ছিল তার। কিন্তু ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরের রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় পানির স্রোতে ভেসে যায় তার দুই মেয়ে। দুর্ঘটনার ১৬ বছর কেটে গেলেও সেই রাতের মর্মান্তিক ঘটনা মনে করে শিউরে ওঠেন বাবা মতি মুন্সি।
৭০ বছর বয়সী মতি মুন্সি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্যার দিন রাতে আমরা সবাই ঘরে একসঙ্গে বসা ছিলাম এর মধ্যে শুনি পানি আসছে। তাই পরিবারের সবাইকে বড় ছেলের সঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিলাম। আর আমি বাড়িতেই ছিলাম। বুক সমান পানি পাড়ি দিয়ে পথে যাওয়ার সময় আমার দুই মেয়ে পানিতে ভেসে যায়। খবর পেয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটে যাই কিন্তু সেদিন রাতে আর আমার দুই মেয়েকে খুঁজে পাইনি। পরের দিন সকালে বড় মেয়ের মরদেহ পাই এবং তার একদিন পর ছোট মেয়ের মরদেহ পাই। এটি আমার জীবনের একটি মর্মান্তিক ঘটনা।
মৃত দুই বোনের বড় ভাই শফিকুল ইসলাম দুলাল মুন্সী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৫ নভেম্বর সেদিন রাতে বাবা আমাদের বললেন তোমরা সবাই আশ্রয়কেন্দ্রে যাও আমি বাসায় থাকি। এরপরে আমি আমার দুই বোন, মা এবং স্ত্রী-সন্তান সহ রওয়ানা দেই। পথের মধ্যে অনেক গাছ পড়েছিল।এর মধ্যেই বুক সমান পানি চলে আসে আর ছিটকে পড়ে যায় আমার দুই বোন। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেদিন রাতে আর তাদের কোথাও পাইনি। পরের দিন অনেক দূরে এক বোনের মরদেহ পাওয়া যায়। আর একদিন পরে আরেক বোনের মরদেহ পাওয়া যায়।
তিনি আরও বলেন, সেদিন আমাদের চোখে কান্না থাকলেও পানি ছিল না। শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি যেন আমার দুই বোনকে আল্লাহ মাফ করে দিও। আশ্রয়কেন্দ্র অনেক দূরে হওয়ায় এবং রাস্তাঘাট ভালো না থাকায় সেদিন এই দুর্ভোগে পড়েছিলাম আমরা। ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদি পশু, সবকিছু হারিয়ে তখন অর্থনৈতিকভাবে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম আর তারমধ্যে দুই বোনকে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না আমারা। খুবই মর্মান্তিক ও সংকটময় মুহূর্ত পার করেছি।
সেদিন রাতের মর্মান্তিক এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জুয়েল মুসল্লি ঢাকা পোস্টকে বলেন, খবর পেয়ে ছুটে আসি ঘটনাস্থলে এবং অনেক খোঁজাখুঁজি করি। কিন্তু কোথাও সন্ধান পাইনি দুই বোনের। পরের দিন তাদের মরদেহ পাওয়া যায় বিলের মাথায় এবং সেখান থেকে এনে দাফন সম্পন্ন করি আমরা।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে আঘাত হানে ভয়ানক ঘূর্ণিঝড় সিডর। আঘাতের সময় সিডরের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার। তবে এ সময় দমকা হাওয়ার বেগ উঠছিল ঘণ্টায় ৩০৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। সিডরের প্রভাবে উপকূলে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। সরকারি তথ্য অনুসারে ১৯৬০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ৩৫টি বড় ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের হদিস পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক পাঁচটি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অন্যতম সিডর।
এসএম আলমাস/আরকে