মেয়ের বিয়ের জন্য সহযোগিতা চাওয়া ওয়াহিদের মেয়েই নেই
এক দিন পর মেয়ের বিয়ে। সেই বিয়ের জন্য পাঁচ হাজার টাকা ধার নিতে যান আত্মীয়ের কাছে। কিন্তু সেই আত্মীয় টাকা না দেওয়ায় রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে কারও সঙ্গে দেখা হলেই এসব দুঃখের কথা বলে কান্নাকাটি করে টাকা নেন। তারপর সেই টাকা নিয়ে করেন নেশা। এসব ঘটনায় সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ওই ব্যক্তির নাম-পরিচয় ও ঠিকানা উদ্ঘাটন করেছে ঢাকা পোস্ট।
তার নাম ওয়াহিদ মোল্লা। তিনি পাবনার বেড়া পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের পাইখন্দ গ্রামের মৃত বাহের উদ্দিন ব্যাপারীর ছেলে। তারা সাত ভাই ও দুই বোন। ২০-২২ বছর আগে তার মা নূর খাতুন মারা যান। আর ১১ বছর আগে মারা যান তার বাবা।
নানা প্রান্তে এমন প্রতারণা করা ওয়াহিদ মোল্লা আগে থেকেই নেশাগ্রস্ত ও প্রতারক ছিল। ছোটবেলা থেকেই মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। রোববার (৫ নভেম্বর) দুপুরে সরেজমিনে পাবনার বেড়া পৌরসভার তার নিজ গ্রামের বাড়ি পাইখন্দতে গিয়ে এমন সব তথ্য পেয়েছে ঢাকা পোস্ট। ছোটবেলা থেকেই তার প্রতারণা ও জীবনীর বর্ণনা দিয়েছেন তার পরিবার ও এলাকাবাসী।
ওয়াহিদের পরিবার ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১৮ বছর আগে বাড়ি থেকে হঠাৎ ফেরারি হন ওয়াহিদ। এর মধ্যে দু-একদিন এলেও শুধু রাতটুকুও থাকতেন। সর্বশেষ গত ৭ বছর আগে বাড়িতে এসেছিলেন পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ২ শতাংশ জমি বিক্রি করার জন্য। সেই দিনই আবার বাড়ি থেকে বের হয়ে ঢাকায় ফিরে যান। এরপর আর বাড়িতে আসেনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় ২০ বছর আগে পারিবারিকভাবে বেড়া পৌরসভার পায়না গ্রামে প্রথম বিয়ে করেন ওয়াহিদ। বিয়ের দেড় বছর পর একটি ছেলে সন্তান জন্ম হয় তাদের। নেশাগ্রস্ত ও প্রতারক হওয়ায় বিয়ের শুরু থেকেই সংসারে অশান্তি চলতে থাকে। এরপর সেই স্ত্রী তাকে তালাক দিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যান।
এর ছয় মাস পর বেড়ার চাকলা ইউনিয়নের পাচুরিয়াতে আরেকটি বিয়ে করেন ওয়াহিদ। স্বামী নেশাগ্রস্ত হওয়ায় বিয়ের ৪-৫ মাসের মাথায় দ্বিতীয় স্ত্রীও তাকে তালাক দিয়ে চলে যান। এরপর ওয়াহিদ বাড়ি থেকে বের হয়ে নিরুদ্দেশ হন। এরপর গত ৭ বছর আগে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দুই শতাংশ জমি অসুস্থতার অজুহাতে বিক্রির জন্য বাড়িতে আসেন। তবে কয়েক ঘণ্টা পরই আবার চলে যান।
এদিকে, গত দুই-তিন দিন আগে মেয়ের বিয়ের কথা বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, এরপর সেই টাকা দিয়ে মদ খাওয়ার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে এলাকাবাসী বিষয়টি জানতে পারেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে এলাকায় বেশ চাঞ্চল্যকর পরিবেশ তৈরি হয়।
ভাইরাল হওয়া ওয়াহিদের ভাই শহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই সে অন্যরকম ছিল। স্কুলে দিয়ে এলে সেখান থেকে কোথাও পালিয়ে যেত। কোনোভাবেই পড়াশুনা করাতে পারিনি। এরপর যখন একটু বড় হলো তখন এলাকা থেকে ভ্যান ভাড়া করে টাকা উপার্জনের জন্য দিতাম। সেই ভ্যান বাজারে নিয়ে বিক্রি করে নিরুদ্দেশ হয়ে যেত। কিছুদিন পর আবার বাড়িতে ফিরে আসত। এরপর আবারও একটি ভ্যানগাড়ি কিনে দেওয়া হলে সেটিও বিক্রি করে কোথাও চলে যায়। এরপর বাবার সঙ্গে ভাঙারির ব্যবসায় পাঠালাম। ভাঙারির মালামাল কিনে দিয়ে গ্রামে পাঠাতাম বিক্রির জন্য। সেগুলো সে মানুষের কাছে বিক্রি না করে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে পালিয়ে যেত।
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্টকে শহিদুল বলেন, ওয়াহিদের প্রথম স্ত্রীর একটি ছেলে সন্তান আছে। তারা গাজীপুরে কাজকর্ম করে জীবনযাপন করছে। ডিভোর্সের পর সে (ওয়াহিদ) নিরুদ্দেশ হলে আর বাড়ি ফিরে আসেনি। ৭ বছর আগে একবার বাড়িতে এসেছিল। এখন আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখে আমরা বিষয়টি জানতে পারি। মূলত সে গ্রামের কিছু খারাপ মানুষের সঙ্গে মিশে সিগারেট খেতে খেতে বড় ধরনের নেশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। জেনেছি, বর্তমানে ঢাকার মিরপুরের হযরত শাহ আলীর মাজারে অধিকাংশ সময় থাকে। সেখানেই খাওয়া-দাওয়া করে। মাঝেমধ্যে কমলাপুর রেলস্টেশন ও মাওনায় দিন অতিবাহিত করে।
ওয়াহিদের ভাতিজা সাব্বির আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার জন্মের পর থেকে চাচাকে মাত্র দুইবার দেখেছি। এরপর আর কোনোদিন দেখা হয়নি। সম্প্রতি তার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে বিষয়টি আমরা জানতে পারি। আমাদের যে সামর্থ্য আছে তাতে চাচা বাড়িতে ফিরে এলে থাকার জায়গাসহ সব ব্যবস্থা করে দেওয়া সম্ভব হবে।
প্রতিবেশী ওসমান গনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোটবেলায় তাকে ভালোই দেখছি। এরপর সে একপর্যায়ে মাদকের সঙ্গে যুক্ত হয়। এরপর মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে। যে কারণে পরপর দুটি বউ চলে যায়। এলাকা থেকে অনেক দিন আগে চলে গেছে। এখন আর কোনো খোঁজখবর নেই। সে যেহেতু মাদকাসক্ত হয়ে গেছে তাহলে তাকে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে সোপর্দ করারও পরামর্শ দেন তিনি।
বেড়া পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সোহেল রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরাও তাকে চিনতাম না। মেয়ের বিয়ের কথা বলে টাকা নিয়ে মদ খাওয়ার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর আমরা জানতে পারি ওয়াহিদের বাড়ি আমাদের বেড়ার ৬নং ওয়ার্ডে। এরপর আমরা বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি সে আগে থেকেই মাদকাসক্ত ও আধাপাগল ছিল। খোঁজখবর করে তাকে বের করে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য বেড়া পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট আশিফ শামস রঞ্জনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোরশেদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর বিষয়টি সম্পর্কে জেনেছি। তবে জেনেছি ঘটনাটি ঢাকায় ঘটেছে। তবে তার বাড়ি যে এখানে সেটা জানতাম না। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেই ভিডিওতে দেখা যায়—অসহায় এক ব্যক্তি তার মেয়ের বিয়ের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দরকার বলে জানাচ্ছেন। ভিডিওতে তিনি সিরাজগঞ্জের বাসিন্দা বলেও পরিচয় দেন। ঢাকার এক আত্মীয়ের কাছে টাকা চেয়ে শূন্য হাতে ফিরেছেন জানালে মানবিকতা দেখিয়ে ভিডিও করা ব্যক্তি তাকে ৬ হাজার টাকা দেন।
পরে ঢাকা পোস্টের আরেকটি প্রতিবেদনে জানা যায়, সেই ব্যক্তি টাকা নিয়ে গত ৩ নভেম্বর রাতে মাওয়া ঘাটে গিয়ে মদ খান। তার প্রতারণার স্বীকারোক্তিমূলক আরেকটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি একজন প্রতারক বলেও ওই ভিডিওতে স্বীকার করেন।
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই ব্যক্তি তার মেয়ের বিয়ের কথা বলে কান্নাকাটি করে বিভিন্ন জায়গা থেকে সহযোগিতা হিসেবে টাকা নিতেন। তিনি ২০১৮ সাল থেকেই এই কাজ করে আসছেন। তিনি সব জায়গায় নিজেকে সিরাজগঞ্জের বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দিলেও অনুসন্ধানে জানা যায় তিনি পাবনা জেলার বাসিন্দা। তার এমন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মানবিক কাজ করা ব্যক্তিরা।
এমজেইউ