পদ্মা সেতু থেকে আমি লাফ দেইনি, পড়ে গিয়েছিলাম!
রিকশা নিয়ে পদ্মা সেতুতে উঠে ঝাঁপ দেন এক তরুণ। কয়েক মাস আগে এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ঝাঁপ দেওয়া তরুণের সন্ধানে নদীতে চলে উদ্ধার অভিযানও। কিন্তু সেই সময় তার কোনো হদিস মেলেনি। এ ঘটনার প্রায় তিন মাস পর শেখ শরিফুল ইসলাম (৩৫) নামে এক যুবক থানায় গিয়ে দাবি করেন তিনিই পদ্মা সেতু থেকে ঝাঁপ দেওয়া সেই ব্যক্তি। ফেরত চান তার অটোরিকশাটি।
শরিফুলের বাড়ি বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার উদয়পুর গ্রামে। তিনি বর্তমানে বাড়িতেই আছেন। ঘটনার পর এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন শরিফুল। পদ্মা সেতু নদীর পানি থেকে প্রায় ১৮ মিটার বা ৬০ ফুট উঁচু। কেন সেদিন সেতু থেকে লাফ দিলেন- এমন প্রশ্নে শরিফুল বলেন, আমি লাফ দেইনি। এক্সিডেন্ট হয়েছিল। আমি সেতুর ওপর থেকে নদীতে পড়ে গিয়েছিলাম।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শরিফুল জানান, ঢাকার হাজারীবাগে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন তিনি। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয়। রাগের বসে তিনি গ্রামের বাড়ি চলে আসবেন বলে মনস্থির করেন। সেই অনুযায়ী রিকশা নিয়ে রওনা হন পদ্মা সেতু হয়ে গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের পথে।
শরিফুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, রং সাইড দিয়ে রাত ৯টার দিকে পদ্মা সেতুতে উঠে গেলাম। রং সাইড দিয়ে উঠায় কোনো টোল দেওয়া লাগেনি। সেতুর ওপর দিয়ে আসতে গিয়ে আমি কোনো বাধা পাইনি। চলতে চলতে ২১ নম্বর পিলারের কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকা একটি কাভার্ডভ্যানের সঙ্গে সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা লেগে সেতুর ওপর থেকে নদীতে পড়ে যাই। এরপর আমার কোনো হুঁশ ছিল না। নদীর ঢেউ আমার নাকে মুখে ঢুকে আমার হুঁশ আসে। নদীতে সহযোগিতা করার মতো কেউ ছিল না। রাতভর আমি নদীতে ভাসতে থাকি। কোথাও কূল পাচ্ছিলাম না। কোথায় আছি, কিছু বুঝতে পারছিলাম না। যখন ভোর হলো, তখন দেখলাম ভাসতে ভাসতে মাঝ নদী থেকে ১০/১৫ কিলোমিটার দূরে চলে এসেছি।
শরিফুল বলেন, নদীর কিনারায় উঠতে গিয়ে একটা রডে আঘাত লেগে জিহ্বা কেটে যায়। রক্ত বের হচ্ছিল। তখন আমি অনেক অসুস্থ। ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলাম না। একটা লুঙ্গি পরা ছিলাম, দেখে পাগলের মতো লাগছিল আমাকে। পরে একটা লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আমি শ্রীনগর থানা এলাকায় আছি। সেখান থেকে মহাসড়কে উঠি। মহাসড়ক দিয়ে গোপালগঞ্জে আমার শ্বশুরবাড়িতে যাই। শ্বশুরবাড়ি থেকে একদিন পরে আমার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটে চলে আসি।
তিনি বলেন, বাড়ি থেকে কেউ বিশ্বাস করছিল না যে আমি পদ্মা সেতু থেকে পড়ে গিয়েছি। সেতুর ওপর থেকে পড়ে যাওয়ার পর আমার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে।
চিকিৎসার জন্য সর্বপ্রথম মোল্লারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাই। সেখান থেকে আমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা অথবা খুলনার দিকে যেতে বলা হয়। তিন মাস পর একটু সুস্থ হলে বাড়ির সবাইকে বললাম পদ্মা সেতু থানায় আমার রিকশাটা রয়েছে, কিন্তু কেউ যায়নি। তিন মাস ১০ দিন পর একটু সুস্থ হলে আমি নিজে গিয়ে রিকশাটি চাইলে পুলিশ আমাকে রিকশাটি দেয়নি। দুইদিন পর আবার গিয়েছি পদ্মা সেতু থানায়। সেতু কর্তৃপক্ষ ভিডিও ফুটেজ দেখে সত্যতা পেলে আমাকে আমার রিকশাটি দিয়ে দেয়।
শরিফুল বলেন, রিকশাটি বাড়ি নিয়ে আসার পর আমি দেনাদারের টাকা পরিশোধ করার জন্য ও উন্নত চিকিৎসার জন্য রিকশাটি ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করি। এরপর আমার স্মার্টফোনটাও পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেই। চিকিৎসার জন্য আমার ঘরটা এখন বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
তিনি আরও বলেন, স্ত্রীকে হারালাম, সন্তানকে হারালাম, এখন নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছি। শারীরিকভাবে অক্ষম আমি। কোনো সহযোগিতাও পাচ্ছি না। কোনো সহযোগিতা পেলে হয়তো দুনিয়াতে আর কয়টা দিন বেঁচে থাকতে পারব।
শরিফুলের বাবা জিন্নাত আলী গাজী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার পর থেকে শরিফুলের স্মৃতিশক্তি অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে। এখনও অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে। তার চিকিৎসার জন্য রিকশা, মোবাইল সব বিক্রি করে দিয়েছে। এখনো ভালোভাবে খেতে পারে না। তাকে দেখলেই কান্না পায়।
চিকিৎসা করার জন্য শরিফুল তার ঘরটা বিক্রি করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য আমার আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় সরকারের সহযোগিতা চাচ্ছি। তা না হলে আমার ছেলেটাকে চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখতে হবে।
প্রতিবেশী শেখ আজমল বলেন, শরিফুল আমার বন্ধু। ওর এতো অসুস্থতা, এত কষ্ট মেনে নেওয়া যায় না। সরকার এবং বিত্তশালীদের কাছে আমাদের সহোযোগিতার আবেদন রইলো। সহযোগিতা পেলে ছেলেটা হয়তো সুচিকিৎসা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।
সাকিব আলী বলেন, পদ্মা সেতু থেকে পড়ে যাওয়ার বিষয়টা তো পুরো বাংলাদেশ জানে। সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন শুধু তাকে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।
উদয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শাইখুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শরিফুল পদ্মা সেতুর ওপর থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা আমি জানি। সরকার থেকে যদি কোনো সহযোগিতা আসে আমি তাকে অবশ্যই দেব।
শেখ আবু তালেব/এমএএস