রায় কার্যকরের অপেক্ষায় নুসরাতের পরিবার
ফেনীর সোনাগাজীর আলোচিত মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত। মৃত্যুশয্যায় থেকেও খুনিদের বিচার চেয়েছিলেন তিনি। বিচারও হয়েছে। এখন রায় কার্যকারের অপেক্ষায় তার পরিবার।
নুসরাত জাহান রাফির দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার (১০ এপ্রিল) তার পরিবারের পক্ষ থেকে সীমিত পরিসরে বাড়িতে কোরআন খতম, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। তার কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ শেষে কবর জিয়ারত করেছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্যরা।
এ সময় পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, নুরসরাতের বাবা একেএস মুসা, বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান, ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান উপস্থিত ছিলেন।
২০১৯ সালের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার নিজ অফিস কক্ষে ডেকে নুসরাতকে যৌন হয়রানি করেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেছিলেন নুসরাতের মা শিরিন আখতার। সেদিনই স্থানীয়দের সহায়তায় অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর তাকে জেল থেকে বের করে আনার জন্য ও মামলা তুলে নিতে তার অনুগতরা নুসরাত ও তার পরিবারকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। ২০১৯ সালের ৩ এপ্রিল অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে কারাগারে পরামর্শ করে এসে ৪ এপ্রিল মাদরাসার ছাত্রাবাসে নুসরাতকে খুনের পরিকল্পনা করেন তারা।
৬ এপ্রিল পরীক্ষা দিতে গেলে অধ্যক্ষ সিরাজের লোকজন নুসরাতকে মাদরাসার সাইক্নোন শেল্টারের ছাদে ডেকে নেয়। মামলা তুলে নিতে চাপ দিলে তিনি অস্বীকার করেন। এ সময় হাত-পা বেঁধে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। তার চিৎকারে ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এরপর তাকে স্থানান্তর করা হয় ফেনী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। ১০ এপ্রিল সেখান মারা যান নুসরাত।
বর্বরোচিত এ ঘটনায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। পরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ডটিকে শুরু থেকে আত্মহত্যা বলে চালাতে চান থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মামলাটি পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়। গণমাধ্যমের দৃঢ় অবস্থান এবং পিবিআইয়ের তদন্তে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসতে থাকে। পুলিশ সদর দফতরের তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় এসপি জাহাঙ্গীর ও ওসি মোয়াজ্জেমসহ চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।
হাসপাতালের বিছানায় জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকেও নুসরাত বিচার চেয়েছিল। এর আগে যৌন হয়রানির পরও ডায়েরিতে তিনি বান্ধবীদের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে যান। যা ঘটনার রহস্য উদঘাটনে কাজে আসে।
এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল মামলা করেন। এই মামলায় ২৮ মে অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২০ জুন অভিযোগ গঠন করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। পরে সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত রায়ের জন্য ২৪ অক্টোবর দিন নির্ধারণ করেন। মামলাটিতে মাত্র ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্ততর্ক গ্রহণ করা হয়। একই বছরের ২৪ অক্টোবর মামলার অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেন।
দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার তৎকালীন অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলা (৫৭), উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদরাসার গভর্নিং কমিটির তৎকালীন সহসভাপতি রুহুল আমিন, মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম (৫০), নুর উদ্দিন, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), প্রভাষক আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন মামুন (২২), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।
নুসরাতের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তার ছোট ভাই রায়হান ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, হারানোর এই ব্যথা স্রষ্টা বিনে বোঝার সাধ্য কারও নেই। অনুভূতিহীন সব ব্যথার নাম আমাদের কান্না, হৃদেয়ের রক্ষক্ষরণ। ভাই বোনের সম্পর্ক বোধহয় এমনি! যেদিন আপু আগুনে পুড়ে হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করছিল, সেদিন মনে হয়েছিল তার কষ্টের সবটুকু আমি ধারণ করি। নিজের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে বলেছিলাম কেঁদো না, তোমার ভাইতো পাশেই আছে। পাশেই থাকবো। যতদিন না সেসব নরপিশাচ কুলাঙ্গারেরা আপন পাপের হিসেব শেষে ফাঁসির মঞ্চে দাড়াঁবেন, ততোদিন ভাই হিসেবে আমি-আমরা পাশেই থাকবোই।
নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বলেন, মরার আগে আমার মেয়ে আমার কাছে পানি আর ভাত খেতে চেয়েছিল। আমি খাওয়াতে পারিনি। ডাক্তাররা নিষেধ করেছে। তার শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। এসব কিছু খাওয়ানো যাবে না। এখন ভাত খেতে গেলে আমার মেয়ের কথা মনে পড়ে। আমার মেয়ে ভাত খেতে পারেনি আমি খাচ্ছি। মনে হয় যেন ভাত খাচ্ছি না বিষ খাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমার মেয়েকে মহান আল্লাহ চারদিন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তার জবান থেকে খুনিদের নাম বেরিয়ে আসার জন্য। আমার মেয়েতো সেই দিনও মরে যেত পারত। আমার মেয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় আমাকে অনেক কথা বলেছে। তখন আমার মেয়েকে আমি বলেছিলাম মামলা তোলার জন্য সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে দিতে। তাহলে আজকে তোমার এই অবস্থা হতো না। তখন আমার মেয়ে আমাকে বলেছিল- মা মৃত্যুকে ভয় পাই না। তারা সাদা কাগজ ধরে সিগনেচার (স্বাক্ষর) চেয়েছিল তখন আমার মেয়ে রাজি না হওয়ায় তারা হাত-পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে আমার মেয়ের গায়ে দিয়াশলাই মেরে আগুন ধরিয়েছিল।
শিরিন আক্তার বলেন, আইনমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন ১০ এপ্রিল নুসরাত দিবস পালন করা হবে। গত বছর পালন হয়নি। এই বছরও পালন করেনি। আগামী বছর থেকে হলেও এই দিবস পালনের দাবি জানাচ্ছি। আসামিদের ফাঁসি হওয়াতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
মামলার বাদী নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায় বিচার পেয়েছি। উচ্চ আদালতেও আমরা ন্যায় বিচার প্রত্যাশী। তবে এখনো খুনিরা ও তাদের স্বজনরা ফেসবুকে বিভিন্নভাবে আমাদের পরিবারকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা এই মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানি না। তবে কিছু দিন আগে আমাদের আইনজীবী শাহাজাহান সাজুর মাধ্যমে জেনেছি করোনা পরিস্থিতির কারণে মামলাটির বেঞ্চ গঠনে বিলম্ব হচ্ছে।
বাদীপক্ষের আইনজীবী এম. শাহজাহান সাজু বলেন, ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার যাবতীয় কার্যক্রম হাইকোর্টে পৌঁছে। আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য বিচারপতি হাসান ইমাম ও সৌমেন্দ্র সরকারের অধীনে এ মামলার শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করেছিলেন প্রধান বিচারপতি। সেই বেঞ্চ করোনার কারণে বাতিল হয়ে গেছে। এর পর বেঞ্চ গঠন হয়নি। তাই মামলাটির শুনানি হচ্ছে না। করোনাভাইরাসের সংকটময় পরিস্থিতি কেটে গেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হবে।
হোসাইন আরমান/আরএআর