‘আমি ওকে অন্য কাউকে দিতে দেব না’
জন্মের কয়েক ঘণ্টা পর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ছেলে। সেই শোকেই দিন কাটছিল মা সোনিয়া খাতুনের। ছেলের শোকে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন সোনিয়া খাতুন। ছেলেকে হারিয়ে রাস্তায় নবজাতক এক কন্যা শিশুকে কুড়িয়ে পেয়েছেন তিনি। শিশুটিকে পেয়ে মৃত সন্তানের শূন্যস্থান পূরণ হয়েছে তার।
ঘটনাটি ঘটেছে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার কুশনা গ্রামে। শিশুটিকে পেয়ে সোনিয়া খাতুনের পরিবারে আনন্দের বন্যা বইছে। তবে শিশুটিকে ভালোভাবে লালন-পালনে যোগ্য ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করতে চায় স্থানীয় প্রশাসন।
সরেজমিনে কুশনা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে পরম মমতায় শিশুটিকে কোলে নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ৪৩ দিন আগে ছেলে হারানো মা সোনিয়া খাতুন। কখনো বসে আবার কখনো হেঁটে বাচ্চাটিকে আদর করছেন। সদ্যভূমিষ্ঠ ছেলে মারা যাওয়ার পর কুড়িয়ে পাওয়া এই মেয়েটিকে নিয়ে পুরণ করছেন ছেলে হারানোর বেদনা। বাচ্চাটিকে এক নজর দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছে তাদের বাড়িতে। কারো যেন নজর না লাগে সে কারণে বাচ্চাটির কপালে কালো টিপ দিয়ে দিচ্ছেন সোনিয়া। ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। দেখে বুঝতে বাকি রইল না সন্তানহারা বুকে পূর্ণতা মিলেছে। মুছে গেছে নাড়ি ছেঁড়া সন্তান হারানোর সেই শোক।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার কুশনা ইউনিয়নের কুশনা গ্রামের মো. বকুল মন্ডলের তিন মেয়ের মধ্যে সোনিয়া খাতুন বড় মেয়ে। ৭ বছর আগে একই উপজেলার বলুহার রামচন্দ্রপুর গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে মো. রানা হামিদের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের পরিবারে আবির নামে ৬ বছরের একটা ছেলে রয়েছে। সোনিয়ার পেটে বাচ্চা রেখে স্বামী রানা প্রবাসে (মালায়েশিয়া) গেছেন পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে। গত সেপ্টেম্বরে কোটচাঁদপুরের মাহাবুবা ক্লিনিকে সিজারের মাধ্যমে ছেলে সন্তানের জন্ম দেন সোনিয়া। কিন্তু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৯ ঘণ্টার মধ্যে বাচ্চাটি মারা যায়। সন্তান হারানোর শোকে কাতর হয়ে পড়েন। এরই মধ্যে গত বৃহস্পাতিবার (২৬ অক্টোবর) সকালে ছোট বোন জিনিয়াকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছিলেন। হাঁটতে গিয়ে দেখতে পান রাস্তার পাশে কাপড়ে মোড়ানো মেয়ে বাচ্চা পড়ে আছে। তখন সেই বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেন সোনিয়া। সদ্যভূমিষ্ঠ ছেলে মারা যাওয়ার পর কুড়িয়ে পাওয়া এই মেয়েটিকে নিয়ে ঘুচছে ছেলে হারানোর বেদনা।
সোনিয়ার চাচাতো ভাই পলাশ ঢাকা পোস্টকে জানান, ৪৩ দিন আগে উপজেলা শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে সিজারের মাধ্যমে ছেলে সন্তান প্রসব করেন সোনিয়া। জন্মের কয়েক ঘণ্টা পর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ছেলেটি। এরপর প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। এখন কন্যা শিশুটিকে পেয়ে খুশি সোনিয়া ও তার পরিবারের সদস্যরা।
সোনিয়ার চাচাতো ভাবি মাহফুজা খাতুন বলেন, আল্লাহ সোনিয়ার কোল থেকে ছেলে বাচ্চা নিয়ে নেওয়ার পর কন্যা সন্তান দিয়েছে। বাচ্চাটি পেয়ে সোনিয়াসহ পরিবারের লোকজন খুবই খুশি। তবে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা বলছেন বাচ্চাটি বর্তমানে উপজেলা প্রশাসনের দায়িত্বে আছে। বাচ্চাটিকে অন্য কোথাও দিয়ে দেবে। তাদের দাবি- বাচ্চাটি যেন সোনিয়ার কাছেই থাকে। কারণ সোনিয়া সন্তানহারা, বাচ্চাটি মাহারা, বাচ্চাটি সোনিয়ার বুকের দুধও পান করছে।
প্রতিবেশীরা জানান, সোনিয়ার কোল শূন্য ছিল। আল্লাহ আবারো তার কোল ভরে দিয়েছেন। কিন্তু যে ব্যাক্তি নির্মমভাবে এই বাচ্চাটি ফেলে গেছেন তিনি কঠিন অপরাধ করেছেন। কতটা অমানবিক হলে এমন জঘন্য কাজ করতে পারে। কত মানুষ একটা সন্তানের জন্য ডাক্তার-কবিরাজ কতকিছু করছে। আর এমন একটা ফুটফুটে বাচ্চা জন্ম দিয়েও তাকে ফেলে দেয়। এটা খুবই কষ্টদায়ক। এদের খুঁজে বের করে আইনের আওয়তা আনা উচিত।
সোনিয়া খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৪৩ দিন আগে আমার দ্বিতীয় সন্তান নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে জন্মের ৯ ঘণ্টা পর মারা গেছে। সেই কষ্ট এখনো ভুলতে পারিনি। মনে কষ্ট নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে ছোট বোনের সঙ্গে হাঁটতে বের হই। কোটচাঁদপুর-তালসার সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাই কাপুড়ে মোড়ানো কিছু পড়ে আছে। তখন কাপড় খুলে দেখতে পাই একটি বাচ্চা। কোথা থেকে এলো, কীভাবে এলো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তখন দেখি বাচ্চাটি জীবিত আছে। কোলে করে বাড়িতে নিয়ে আসি। বাড়িতে আনার পর বাচ্চাটির গায়ের ময়লা পরিষ্কার করি, বুকের দুধ দেই। এরই মধ্যে জানাজানি হয়ে যায় বাচ্চাটির কথা। পুলিশ আসে এবং বাচ্চাটিকে চিকিৎসা দেওয়ার কথা বলে। আমি ওকে কোটচাঁদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই। ডাক্তার বাচ্চাটিকে দেখেন এবং বলেন সুস্থ আছে। ডাক্তার দেখানো হয়ে গেলে বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে আসার পর জানতে পারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কোটচাঁদপুর থানার ওসি ও সমাজসেবা কর্মকর্তা সবাই বাচ্চাটিকে অন্য জায়গাই দেওয়ার জন্য বলছে।
তিনি বলেন, কিছুদিন হলো ছেলে সন্তান হারিয়েছি। ছেলে হারিয়ে মেয়েকে পেয়েছি। আমি ওকে কখনো অন্যের হাতে তুলে দিতে পারবো না। আমি গরিব বলে আমার কাছে সে ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারবে না- সবাই এমন কথা বলছে। গরিবের ঘরের সন্তানরাও অনেক ভালো থাকে, মানুষের মতো মানুষ হয়, অফিসার হয়। আমি ওকে অন্য কাউকে দিতে দেব না। আমার সন্তান আমার কাছেই থাকবে।
কুশনা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান বাবুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কোটচাঁদপুর থানার ওসি ও সমাজসেবা কর্মকর্তা সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাচ্চাটিকে একটা নিরাপদ ও সচ্ছল পরিবার দেখে তাদের হেফাজতে দেবেন। ছোট্ট নবজাতককে কীভাবে কার কাছে দেবেন সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। তবে কিছু দিন হলো সোনিয়ার একটা ছেলে বাচ্চা মারা গেছে। বাচ্চাটি সোনিয়ার কাছে থাকলে লালন-পালন করতে সমস্যা হবে না। তার কাছে থাকলেই ভালো হবে।
কোটচাঁদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. তারণী পাশা ঢাকা পোস্টকে জানান, শিশুটিকে নিয়ে হাসপাতালে আসছিল ওই পরিবার, তাকে ভালোভাবে দেখা হয়েছে। শিশুটির শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল।
কোটচাঁদপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিশুটিকে হস্তান্তরের জন্য বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) আবেদন আহ্বান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাতজন আবেদন করেছেন। এখনো বেশ কিছু আবেদন আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। আবেদন নেওয়া শেষ হলো উপজেলা শিশু কল্যাণ বোর্ডের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে শিশুটিকে কার কাছে দিলে ভালো হয়। মিটিংয়ে যদি সিদ্ধান্ত হয় যার কাছে আছে তার কাছে রাখলে ভালো হবে, তাহলে তার কাছেই থাকবে। তবে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা হয় এমন ব্যক্তির কাছে তাকে হস্তান্তর করা হবে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন/আরএআর