চা পাতার লোকসান পুষিয়ে দিচ্ছে সাথি ফসল মাল্টা
সমতল ভূমির চা উৎপাদনে দেশের শীর্ষে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে চা চাষে বদলে গেছে এ অঞ্চলের অর্থনীতি। এ চা শিল্পের হাত ধরে প্রান্তিক এ জেলার আর্থ-সামাজিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কিন্তু মহামারি করোনার পর থেকে চা পাতার দাম অব্যাহতভাবে কমতে থাকার ফলে লোকসানে পড়েন চা চাষিরা। যার ফলে চাষিরা চা বাগানে আবাদ করছেন সাথি ফসল মাল্টা। সাথি ফসলের চাষ করে চা পাতার দামের ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছেন তারা।
পঞ্চগড় জেলার চা বাগানগুলোতে একসময় সাথি ফসলের পরিমাণ কম থাকলেও তা দিনদিন বাড়ছে। মাল্টার পাশাপাশি এসব ফসলের মধ্যে রয়েছে আম, পেঁপে, সুপারি, আমলকী, লিচু প্রভৃতি। এ আবাদগুলোর মধ্যে চা বাগানে বর্তমানে মাল্টা ও আম চাষে ঝুঁকেছেন চাষিরা। কয়েক বছর ধরে সাথি ফসল উৎপাদনে নীরবে বিপ্লব ঘটেছে নতুন অর্থনীতি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, পঞ্চগড় জেলায় ৮০ হেক্টর জমিতে সাথি ফসল আবাদ হচ্ছে। তার মধ্যে তেঁতুলিয়া উপজেলায় প্রায় ৫০ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে মাল্টা। আবহাওয়া মাটি এবং পরিমিত বৃষ্টিপাতের কারণে এ উপজেলায় বারি-১ জাতের মাল্টার চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। চাসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষেতে সমন্বিত ফসল হিসেবে মাল্টার বাগান করছে চাষিরা। তেঁতুলিয়া উপজেলায় কাজীবাড়ি, বড়বিল্লাহ, তেলিপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া, রওশনপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় চা বাগানে আম ও মাল্টা আবাদ হচ্ছে। চা বাগানে প্রয়োগকৃত সার-কীটনাশকেই একাধিক আবাদ সহজ হওয়ায় সমতল ভূমির বিস্তীর্ণ চা বাগানগুলোতে মাল্টা চাষে মনোযোগ দিয়েছেন চাষিরা।
জানা যায়, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় রওশনপুর এলাকার ফেরদৌস কামালের ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী সাদেকুল ইসলাম সুষমের হাত ধরেই এ অঞ্চলে প্রথম চা বাগানে সাথি ফসল হিসেবে মাল্টা চাষ শুরু হয়। করোনাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ায় ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে বাবার দুই একর জমিতে ২০০ বারি-১ জাতের মাল্টা চাষ শুরু করেন। এরপর থেকে এ এলাকায় বিভিন্ন চা বাগানে চাষিরা ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল মাল্টা চাষে ঝুঁকে পড়েন।
চাষিরা বলছেন, আবহাওয়া মাটি ও পরিমিত বৃষ্টিপাতের কারণে জেলায় চা বাগানে একাধিক সাথি ফসল ফলাতে পারছেন তারা। চা বাগানে যে সার কীটনাশক ব্যবহার করা হয় তা দিয়েই এসব সাথি ফসল উৎপাদন করা যায়। এতে উৎপাদন খরচও কম হয়। চা পাতা আর মাল্টা বিক্রি করে বেশ লাভ হয় তাদের। এখানকার মাল্টার মান ভাল হওয়ায় পাইকাররাও কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন জেলায়। সমতল ভূমিতে চা চাষের সঙ্গে সাথি ফসল ফলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
তেঁতুলিয়া উপজেলার একজন সফল বড় চা চাষি কাজী আনিসুর রহমান। তিনি প্রায় ২০ একর জমিতে গড়ে তোলা চা বাগানে ৩ হাজার দেশি ও বিদেশি জাতের উদ্ভাবিত বারি ৪, বানানা ম্যাংগো আমের চারা লাগিয়ে সাথি ফসল আবাদ করছেন। তাকে অনুসরণ করে তেঁতুলিয়া সদরের কাজী মশিউর রহমান, কাজী মাহবুবুর রহমান, কাপড় ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফসহ বেশ কিছু চা বাগান মালিক চা বাগানে আম চাষ করছেন।
তিরনই হাট ইউনিয়নের কৃষক আতাউর রহমান বলেন, ২৫ শতক জমিতে চা বাগান করি। পরে চা বাগানেই মাল্টা চাষ করেছি। গাছগুলোতে ফল ধরেছে। দু’এক মাসের মধ্যে পরিপক্ব হবে। চা বাগানে বাড়তি আবাদ হিসেবে মাল্টা বিক্রি করে অর্থ আয় করতে পারবো। বিশেষ করে বর্তমানে বাগানে উৎপাদিত চা পাতার দাম নেই। আমরা পাতা বিক্রি করে লোকসান গুনছি। সেখানে বাড়তি আয়ের জন্যই মাল্টাসহ পেঁপে ও অন্যান্য ফলের গাছ লাগিয়েছি।
শালবাহান ইউনিয়নের খালপাড়া এলাকার তরিকুল ইসলাম বলেন, আমি ৬ একর জমিতে চা বাগান করেছি। সে চা বাগানে মিশ্র ফসল হিসেবে ২ হাজার ৫০০ আম গাছ লাগিয়ে চলতি বছর আম বিক্রি করে সাত লাখ টাকা আয় হয়েছে। বিশেষ করে এ বছর আমের দাম তেমন ভালো যায়নি। চা পাতার দাম না থাকার কারণে সাথি ফসল করে কিছুটা লাভবান হওয়া যায়।
চা বোর্ড বলছে চা বাগানে মিশ্র চাষে কৃষকরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাগানে বড় পাতার কোনো গাছ থাকলে তা চায়ের উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। কিন্তু চাষিরা বলছেন, তারা চা এর সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে মাল্টা, আমসহ অন্যান্য আবাদে চা বাগানের ক্ষতি করবে না, বরং আর্থিক সচ্ছলতা বাড়বে।
তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, মাল্টা ফলটি বিশ্বের উষ্ণ ও অব-উষ্ণমন্ডলীয় এলাকায় বেশি চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশে পাহাড়ি এলাকা ছাড়াও দেশের অন্যান্য এলাকার মতো এ উপজেলায় মাল্টা চাষ হচ্ছে। সমতল ভূমিতে চায়ের পাশাপাশি মালটা চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। উপজেলার প্রায় ৫০ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে মাল্টা। তা সিংহভাগ আবাদ হচ্ছে চা বাগানে। চায়ের পাশাপাশি মাল্টা চাষ কৃষকদের দ্বিগুণ আয়ের সুযোগ তৈরি করেছে। মাল্টা চাষে আগ্রহী চাষিদের সকল প্রকার সহায়তা দিচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিসের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন জানান, আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চা চাষ করতে গিয়ে বাগানে যে আলোর প্রয়োজন তা মেটানোর জন্যে আমরা চাষিদের কড়ই, অথবা নিম গাছ শেড ট্রি হিসেবে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকি। চা বাগানে অন্য ভারি পাতার কোনো গাছ থাকলে পোকা মাকড়ের প্রকোপ বেড়ে গিয়ে বাগানে আলোর অভাব দেখা দেয়। এতে ফলন কমে আসে। বর্তমানে এ অঞ্চলের চা চাষিরা চায়ের সঙ্গে সাথি ফসল উৎপাদনে আম ও মালটা চাষ শুরু করেছে। নিরাপদ দূরত্ব বুঝে চা বাগানে আম এবং মাল্টা গাছ লাগালে চা এর তেমন কোনো ক্ষতি হবে না।
এসকে দোয়েল/এএএ