২১ বছর ধরে ভেঙে পড়ে আছে সেতু, ভোগান্তিতে লক্ষাধিক মানুষ
ফেনীর সোনাগাজী ও নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের মধ্যে যোগাযোগের জন্য সংযোগ মাধ্যম ছিল কাজিরহাটে ছোট ফেনী নদীর ওপর রেগুলেটর সেতু। দুই দশক আগে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া কাজীরহাট রেগুলেটরের স্থলে নতুন করে সংযোগ সেতু না হওয়ায় যাতায়াতে দুর্ভোগে পড়েছেন দুই অঞ্চলের লাখো মানুষ। দুই পাড়ের সাধারণ মানুষের দাবি, রেগুলেটর সংস্কার করা সম্ভব না হলে এ নদীতে একটি সেতু নির্মাণ করা হোক।
স্থানীয়রা জানান, কেনো সংযোগ সেতু না থাকায় যাতায়াতের একমাত্র ভরসা নৌকা। কিন্তু নদী তীরবর্তী দুই লাখ মানুষের জন্য নৌকা রয়েছে মাত্র ২-৩টি। ২০০ মিটার এই নদীপথে নৌকায় প্রতিদিন প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষ চলাচল করে। বাগিশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরসাহাভিকারী উচ্চবিদ্যালয়, উত্তর চরসাহাভিকারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাফেজ সামছুল হক নুরানি মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী, আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা, মসজিদ, মক্তবের লোকজনসহ এ নৌকা ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হয় শিক্ষার্থী, কর্মজীবী ও ব্যবসায়ীসহ হাজারো মানুষ।
স্থানীয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ১৯৬১-৬২ সালে ছোট ফেনী নদীর ওপর কাজির হাট নামক স্থানে ২০ গেইট বিশিষ্ট একটি রেগুলেটর নির্মাণ করা হয়। ওয়াপদা কর্তৃপক্ষ রেগুলেটর রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিবছর রং করাসহ মেরামতের জন্য ১০ লাখ টাকার তহবিল প্রদান করেন। নির্মাণের পর থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই টাকায় রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হলেও স্বাধীনতার পর ওয়াপদা বাদ দিয়ে এই মন্ত্রণালয়কে পানি উন্নয়ন বোর্ড করা হয়। তখন রাষ্ট্রের খরচ কমাতে জনবল ও মেরামতের টাকা অর্ধেকে নেমে আসে।
স্থানীয় সিনিয়র সংবাদকর্মী জসিম উদ্দিন কাঞ্চন ঢাকা পোস্টকে জানান, রক্ষণাবেক্ষণের তহবিল থেকে আসা এই টাকায় মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে নামে হয়েছে হরিলুট। ফলে যথাযথ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে ২০০২ সালে রেগুলেটরটি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। রেগুলেটরের একপাশে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মৌলভী বাজার, কদমতলা বাজার, চরহাজারী বাজার, বসুরহাট বাজার, চৌধুরী হাটবাজার। অন্যপাশে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার কেরামতিয়া বাজার, কাজীরহাট বাজার, লিঙার বাজার, জমদ্দার বাজার, চান মিয়ার বাজার, ধনিপাড়া বাজার, ইতালি মার্কেট বাজার ও ওলামা বাজার। একমাত্র সংযোগ সেতুটি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় ওই অঞ্চলের মানুষ নিরুপায় হয়ে কষ্ট করে যাতায়াত করছে নৌকায়।
আবদুর রহমান নামে এক মাদ্রাসা ছাত্র জানায়, প্রতিদিন এই নৌকা পার হতে তাদের ২০ থেকে ৩০ টাকা দিতে হয়। ঝড়-বৃষ্টি হলে অনেক সময় মাদ্রাসায় যাওয়া যায় না।
স্থানীয় চরদরবেশ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য খায়রুল ইসলাম টিপন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফেনী জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোগ সড়ক এটি। রেগুলেটর না থাকার পরও প্রতিদিন মানুষ নৌকা দিয়ে পার হচ্ছে। এখানে সেতু নির্মাণ সময়ের দাবি।
সোনাগাজীর চরদরবেশ ইউনিয়নের বাসিন্দা মাইন উদ্দিন লিটন বলেন, রেগুলেটর থাকাকালীন এটির ওপর দিয়ে ছোট যানবাহন চলাচল করতো। পরবর্তী দীর্ঘ দুই দশক ধরে নদী পারাপারে ভোগান্তি পোহাচ্ছে দুই পারের মানুষ।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, বিভিন্নসময় মন্ত্রী এমপিসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা প্রতিশ্রুতি দিয়েও কথা রাখেনি। বিগত জাতীয় নির্বাচনে দুই উপজেলার জনপ্রতিনিধিরা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইশতেহার ঘোষণা করলেও কাজিরহাট রেগুলেটরের ওই স্থানে সেতু নির্মাণ হয়নি।
কোম্পানিগঞ্জের চরহাজারী এলাকার বাসিন্দা আমির হোসেন বলেন, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রীর এলাকা হওয়ার পরও এখানে দুই লাখ মানুষ দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। অসহায় জনগণের সঙ্গে প্রতারণা চলছে। অথচ নির্বাচনী ইশতেহারে সেতু নির্মাণের কথা থাকলেও আর কেউ মনে রাখেনি।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরপার্বতী গ্রামের বাসিন্দা মো. রজিম মিয়া জানান, কাজিরহাট এলাকায় তার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। নৌকায় করে যাতায়াত করতে গিয়ে প্রতিদিন তার ১০০ করে টাকা খরচ হয়। ভোগান্তি কমাতে সেতু নির্মাণের দাবি জানান তিনি।
নদী পারাপারে জনসাধারণের ভোগান্তি এবং নতুন সেতুর জন্য মানুষের দীর্ঘদিনের দাবির বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, দুই দশক ধরে সেতু নেই, সেতু নির্মাণে জনগণের দাবি তো অবশ্যই থাকবে। এ বিষয়ে আমি অবগত ছিলাম না। জনগণের দীর্ঘদিনের দাবির বিষয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও কখনো বলেনি। বিষয়টি এখন জেনেছি, সেতু নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কাজিরহাট থেকে নোয়াখালী জেলার বসুরহাট সড়কে ছোট ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য ২০২১ সালের জুন মাসে নদীতে সয়েল টেস্ট করা হয়েছিল। কিন্তু এলাকাবাসীরা বলছেন, অজ্ঞাত কারণে সেতু নির্মাণ কাজ আলোর মুখ দেখেনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সোনাগাজী উপজেলা উপ-সহকারী প্রকৌশলী (আরসিআইপি) রবিউল আলম জানান, ২ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে সয়েল টেস্ট করা হয়েছে। ২০২১ সালের জুন মাসে সার্ভে রিপোর্ট ফেনী স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের পাঠানো হলেও সেতুর দৈর্ঘ্য নিয়ে জটিলতায় ফাইলটির অগ্রগতি হয়নি।
এ প্রসঙ্গে সোনাগাজী উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল কাদের মোজাহিদ বলেন, নতুন সেতু নির্মাণে দৈর্ঘ্য ৭৫ মিটার পর্যন্ত অনুমোদনের ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবে পরিমাপ করে দেখা যায় সেতু নির্মাণ করতে হবে ১২০ মিটার। অন্যদিকে জিএমপি-৩ এর মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত থাকলেও এর মধ্যে নতুন করে কোনো সেতু প্রকল্প নেবে না। সেজন্য কাজিরহাট-বসুরহাট সড়কে সেতু নির্মাণের এ প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সেতু নির্মাণ করতে হলে ১০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের সেতুর জন্য নতুন করে ভিন্ন কোনো প্রকল্পের পদক্ষেপ নিতে হবে।
তারেক চৌধুরী/এএএ