‘সেদিন পিরুকে টিভিতে দেখে অবাক হয়েছি’
কৃষক পরিবারের সন্তান পিরু মোল্লা (৩১)। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ে চালিয়েছেন লেখাপড়া। এখন তিনি বিসিএস ক্যাডার। তার সংগ্রামী জীবনের গল্প শুনে চোখ ভিজেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে তার বক্তব্যের ভিডিও। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে পিরু মোল্লার সংগ্রামী জীবনের গল্প। তিনি এখন অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা। তাকে নিয়ে গর্ব করে এলাকাবাসী।
পিরু মোল্লা ফরিদপুর সদর উপজেলার অম্বিকাপুর ইউনিয়নের উত্তর শোভারামপুর গ্রামের মো. জাহাঙ্গীর মোল্লা ও কুলসুম বেগমের ছেলে। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তিনি ৪০তম বিসিএসে নিরীক্ষা ও হিসাব শাখা ক্যাডারে ১৫তম মেধাক্রমে সহকারী মহাহিসাবরক্ষক পদে যোগদান করে সংযুক্ত আছেন ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট একাডেমিতে (ফিমা)।
গত রোববার (৮ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বিসিএস কর্মকর্তাদের ৭৫তম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে চারজন বিসিএস ক্যাডার তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। তারই একজন ফরিদপুরের পিরু মোল্লা। কৃষক পরিবারের ছেলে পিরু মোল্লার সংগ্রামী জীবনের গল্প শুনে প্রধানমন্ত্রীও চোখের পানি মুছেন। ওই অনুষ্ঠানেই পিরুকে কাছে ডেকে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
পিরুর সংগ্রামী জীবনের গল্প জানতে তার শিক্ষক, প্রতিবেশী ও এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, মাতৃভক্তি আর বিনয় তাকে এত ওপরে উঠিয়েছে। পিরুর মত ছেলেই হয় না। তিনি এলাকার গর্ব।
পিরুর বন্ধু ও সহপাঠীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ২০০০ সালে তিনি তার গ্রামে অবস্থিত শোভারামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন। ২০০৫ সালে অম্বিকাপুরের আনছারউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি ও ২০০৭ সালে ফরিদপুর শহরের সরকারি ইয়াছিন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে ২০১৩ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন।
শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি নিজ বাড়ি শোভারামপুরে চলে আসেন। সেখানে থেকেই তিনি ফরিদপুর শহরে একটি বিসিএস কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন। পাশাপাশি ফরিদপুর শহরে শুরু করেন টিউশনি। মেধাবী ছাত্র পিরুর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পরে সারা শহরে। টিউশনির পাশাপাশি চলতে থাকে বিসিএসের প্রস্তুতি। এর মধ্যে কয়েকটি বিসিএসে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় টিকেও শেষ পর্যন্ত বিবিএস ক্যাডার হতে পারেননি। সর্বশেষ তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সহকারী প্রোগ্রামার হিসেবে চাকরি পান। বিসিএস পাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ওই চাকরিতেই ছিলেন।
পিরুর বন্ধু ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র ও বর্তমানে ভাঙ্গা উপজেলার আবদুল্লাবাদ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক শেখ নুরুল বলেন, আমরা ফরিদপুরে একসঙ্গে কোচিং করেছি। অনেক ভালো সময় কেটেছে। পাশাপাশি কষ্ট ও সংগ্রামের সময় আমরা একসঙ্গে পার করেছি। আমরা একসঙ্গে যারা কোচিং করতাম শেষ পর্যন্ত প্রায় সবাই বিসিএস ক্যাডার বা অন্যান্য সরকারি চাকরিতে যোগদান করেছি। কিন্তু আমাদের দুজনের ভাগ্য কেমন যেন কোথায় বাঁধা ছিল। প্রিলিমিনারি টিকলে লিখিত ফেল। শেষমেষ মনে হতো আমাদের দিয়ে কিছুই হবে না। পরে পিরু একটি সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়, আমি স্কুলে যোগ দেই।
তিনি বলেন, পিরুর আর্থিক অবস্থা যে এতটা খারাপ আমরা সঙ্গে থেকে বুঝতাম না। ও আমাদের খাওয়ানোর চেষ্টা করত সব সময়। তবে তার পারিবারিক ক্রাইসিস আমরা জানতাম। এখন মনে হচ্ছে বুকে কতটা ক্ষত লুকিয়ে পিরু আমাদের সঙ্গে হেসে খেলে সময় পার করেছে।
পিরুর প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নানা সংগ্রাম ও পারিবারিক সংকটের মধ্যে তিনি বড় হয়েছেন। তার বাবা ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বড় ভাই সৌদি আরব প্রবাসী ছিলেন। অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন দেনার বোঝা নিয়ে। সেজো ভাই বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। একমাত্র বোন স্বামী হারিয়ে দুই সন্তান নিয়ে ভাইয়ের সংসারেই এসে উঠেছেন। মেজো ভাই ও বোন ক্যান্সারে আক্রান্ত। এদেরকে নিয়মিত কেমোথেরাপি দিতে হচ্ছে। এসব খরচ পিরুকে বহন করতে হয়।
ফরিদপুর শহর থেকে আনুমানিক ৫ কিলোমিটার দূরে উত্তর শোভারামপুর গ্রামে আনুমানিক ৩০ ফুট লম্বা ১৫ ফুট চওড়া একটি সেমিপাকা ঘরে বসবাস করেন এই পরিবারের সদস্যরা। মেঝে পাকা ঘরটির টিন পুরোনো হওয়ায় গোলাপি রঙ দিয়ে টিনের ভগ্ন অবস্থা ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে।
কথা হয় পিরুর প্রতিবেশী রাবেয়া বেগমের (৬১) সঙ্গে। তিনি বলেন, পিরুদের পরিবারে আগে অভাব ছিল। ছোটবেলায় তার বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির জোগালি হিসেবে, ধানের ক্ষেতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছে। আমাদের এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষ রাজমিস্ত্রির কাজ করে। সেখান থেকে পিরু যে এত ওপরে উঠবে আমরা কখনো ভাবিনি। সেদিন পিরুকে টিভিতে দেখে অবাক হয়েছি। নাতি-নাতনিদের বলেছি- দেখ পড়াশোনা করলে প্রধানমন্ত্রীর সামনে কথা কওয়া যায়, তোরা ভালো করে পড়াশোনা করলে তোর পিরু কাকার মত বড় অফিসার হবার পারবি।
তিনি বলেন, পিরুকে দেখতাম ও খুবই মায়ের ভক্ত। মায়ের কষ্ট সহ্য করতে পারত না। বাড়ির সবাই বেড়াতে গেলেও মাকে কখনো কোথাও বেড়াতে যেতে দিত না। মায়ের আঁচলে আঁচলে থাকত। এমন মা ভক্ত ছেলে আমি কমই দেখেছি।
আরেক প্রতিবেশী কবির শেখ (৬৬) বলেন, ওরা ভাই-বোন সবাই ভালো। ছোটবেলা থেকে কোনো দিনও ওদেরকে কারো সঙ্গে ঝগড়া ফ্যাসাদ করতে দেখিনি। পিরু বাড়িতে যতদিন থাকতো পড়াশোনা নিয়েই থাকত। দেখা হলে সালাম দিত। পিরুকে টিভিতে দেখে সন্তানদের বললাম, তোরা একই বয়সী ছিলি, পড়াশোনা করে সে আজ কোথায়, তোরা আজ কোথায়।
শোভারামপুর গ্রামের বাসিন্দা রাজমিস্ত্রির সরদার মোহাম্মদ আলী (৭১) বলেন, ছোটবেলায় আমি আমার বিভিন্ন সাইডের কাজে ওর বড় ভাই ও বাবাকে মিস্ত্রি হিসেবে নিতাম। ও স্কুল-কলেজের ফাঁকে ফাঁকে আমার কাজে জোগালি হিসেবে অনেকদিন কাজ করেছে। বিভিন্ন ছুটিতে বন্ধ ও মাঝে মাঝে স্কুল বন্ধ দিয়েও কাজ করেছে আমার সঙ্গে। তখন জোগালি হিসেবে ওকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দিতাম। কাজের ব্যাপারে পিরু খুব সিরিয়াস ছিল। যা বলতাম তাই করতো, কখনো আপত্তি করতে দেখিনি।
তিনি বলেন, আজ ও বিসিএস ক্যাডার হয়েছে শুনে ভালো লাগছে। আমাদের গ্রামে আরও এমন অনেক বিসিএস ক্যাডার হোক এটাই আমাদের চাওয়া। পিরু এই গ্রামের গর্ব, আমাদের অহংকার।
আনছারউদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক খালেদ বিন ইসলাম বলেন, পিরু স্কুলে থাকাকালীন খুবই নম্র, ভদ্র, স্বল্পভাষী ও বিনয়ী ছিল। ক্লাসের পড়া ক্লাসেই পড়ে আসত। ওদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। পিরু মাঝে মাঝে দুইদিন তিন দিন স্কুলে আসত না। খোঁজ নিলে দেখা যেত, স্কুলে না এসে বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে কোনো কাজে গিয়েছে টাকার দরকারে। ওর অসচ্ছলতা দেখে বিভিন্ন সময়ে স্কুলের ফি ও বেতন কমানো বা মওকুফও করা হয়েছে।
শোভারামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহানা নাসরিন নাহার বলেন, এই স্কুলের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী বিসিএস ক্যাডার হয়েছে বলে আমরা গর্বিত। আমাদের শিক্ষার্থীদের পিরুর সংগ্রামী জীবনের গল্প শুনিয়ে অনুপ্রেরণা দিচ্ছি।
পিরুর মা কুলসুম বেগম (৭১) বলেন, পিরু ছোটবেলা থেকেই বইপাগল ছেলে ছিল। ওর বই পড়া দেখে প্রতিবেশীরা সবাই বলতো আর কতকাল পড়বে তোমার ছেলে, চাকরি-বাকরি কবে পাবে।
তিনি বলেন, ও বাইরে থেকে এসেই আগে আমার খবর নেয়। আমার যন্ত্রণা তো দূরে থাক আমার মুখের ‘উহ’ শব্দটাও ও সইতে পারে না।
পিরু যখন শোভারামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তখন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মোসলেম উদ্দিন শিকদার (৮২)। গত ১৭ বছর ধরে তিনি অবসর জীবনযাপন করছেন। তিনি বলেন, পিরু যেদিন প্রথম স্কুলে ভর্তি হতে আসে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী দিয়ে ভাত খেয়ে এসেছো। সে বলেছিল পুঁটি মাছ। তাকে পুঁটি মাছ লিখতে বললে সে লিখতে পারেনি। তখন আমরা তাকে ভর্তি নেব না বলে জানিয়ে দেই। এরপর সে তার মায়ের সঙ্গে বাইরের মাঠে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য মাটিতে গড়াগড়ি করতে থাকে। পরে তাকে আমরা বাধ্য হয়ে ভর্তি নেই। অবশ্য সেদিনই কয়েকবারের চেষ্টায় সে পুঁটি মাছ লিখতে পেরেছিল।
তিনি বলেন,তার সাফল্য দেখে মনে হচ্ছে আমার শিক্ষকজীবন সফল। ৬০ টাকা বেতনে শিক্ষকতা শুরু করেছিলাম। কখনো টাকার দিকে তাকাইনি। আমার কত ছেলে-মেয়েরা বড় বড় পদে গেছে। দেশের সেবা করছে।
মোসলেম উদ্দীন বলেন, আমার বয়স ৮২ হয়ে গেছে আর হয়তো বেশি দিন বাঁচবো না। ওরা ভালো কিছু করলে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে আমার। পিরুকে সেদিন ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখে ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের কাছে ওর গল্প করেছি। শিক্ষকজীবনের অনেক সফলতার মধ্যেও এটা একটা সফলতা যে পিরু আমার ছাত্র ছিল।
আরএআর