‘যখনি সংসারটা গোছাতে শুরু করি, তখনি তিস্তার ভাঙনে সব শেষ হয়ে যায়’
একদিন যার সবকিছু ছিল, এখন তার কিছুই নেই। সর্বনাশা তিস্তা কেড়ে নিয়েছে তাদের ভিটেমাটিসহ ফসলি জমি। এখন তারা ঠিকানা বিহীন। সবকিছু হারিয়ে অন্যের জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই আশ্রয়টুকুও এবার তিস্তার গর্ভে চলে গেছে।
বলছিলাম কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের রামহরি এলাকার হাফিজুর রহমানের স্ত্রী আলেমা বেগমের কথা (৫০)। তিনি তার জীবনে ৫-৬ বার তিস্তার ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়েছেন। এখন আশ্রয়ের জায়গাটুকুও হারিয়ে নিঃস্ব তিনি।
তিস্তার ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আলেমা বেগম বলেন, কয়দিন আগে তিস্তার ভাঙনে ভিটেমাটি নদীতে চলে গেছে। এখন আমার পরিবার নিয়ে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। নিজেদের ভিটেমাটি হারিয়ে ১০ বছরের চুক্তিতে একজনের জমিতে বাড়ি করেছিলাম সেটাও নদীতে চলে গেল। গত এক সপ্তাহ ধরে স্বামী সন্তান নিয়ে প্রতিবেশির বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আছি।
তিনি বলেন, আমার বিয়ে হওয়ার পর থেকে ৫-৬ বার তিস্তার ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়েছি। যখনি একটু সংসারটা গোছাতে শুরু করি, তখনি তিস্তার ভাঙনে সব শেষ হয়ে যায়।
আলেমা বেগমে আরও বলেন, বর্তমানে দুই ছেলে, এক মেয়ে ও আমরা দুইজনসহ ৫ জন অন্যের বাড়িতে আছি। এভাবে আর কতদিন থাকব কন? আমার স্বামী দিনমজুর। কোথাও জমি কিনে বাড়ি করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। এখানে নদী ভাঙা মানুষের সংখ্যা বেশি থাকার কারণে এখন আর চুক্তিতেও জমি পাওয়া যাচ্ছে না। এখন কোথায় যাব, কি করব চিন্তা করে কূল-কিনারা পাই না। শেষ পর্যন্ত আমার কপালে এই ছিল বুঝি।
শুধু রামহরি এলাকার আলেমা বেগম নন, তার মতো অনেকে তিস্তার ভাঙনে বাপ-দাদার ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। আবার ভিটেমাটি হারানো কেউ কেউ অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের রামহরি এলাকার রহিম মিয়া নামের আরও একজন বলেন, আমারও কয়েকদিন আগে ভিটেমাটি তিস্তা নদীতে চলে গেছে। যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আছি। বউ-বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাব, কি করবো চিন্তায় বাঁচি না। কি যে হবে আল্লাহ পাক ছাড়া কেউ জানে না।
জানা গেছে, তিস্তার পাড় নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও ভাঙছে আবার পানি কমলেও ভাঙছে। যার ফলে গত তিনদিনে তিস্তার অববাহিকার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের প্রায় ২৫-৩০টি পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। এর মধ্যে যাদের জায়গা জমি নেই, তারা অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এছাড়া ওই ইউনিয়নে হুমকির মুখে রয়েছে কালির মেলা বাজার, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদরাসাসহ অনেক বাড়ি ঘর ও ফসলি জমি। এর আগেও শুধু রাজারহাট উপজেলার তিস্তা নদীর অববাহিকার বিভিন্ন এলাকায় শত শত পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছেন।
রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের ১নং ওর্য়াডের ইউপি সদস্য (মেম্বার) আব্দুল বাতেন বলেন, গত তিনদিনে আমার ওর্য়াডের ২৫টির মতো বাড়ি ভেঙেছে। এর মধ্যে ১০-১২ জনের অবস্থা খুব খারাপ। নিজেদের জায়গা-জমি না থাকার কারণে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। আমরা তাদের বলেছি আমন ধান কাটা শেষ হলে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। আমার এলাকার রামহরি ও কালির মেলা এলাকায় এখনো ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।
রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, কুড়িগ্রামে গত ২৪ ঘণ্টায় ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা আগামী ৮ অক্টোবর পর্যন্ত থেমে থেমে অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাবেরী রায় বলেন, আমি অল্পকিছু দিন হয় এই উপজেলায় এসেছি। তিস্তা তো সবসময় ভাঙে। তবে এবার ভারত থেকে খুব ঘন ও কাদা যুক্ত পানি আসছে। এ কারণেই ভাঙন বেশি হতে পারে। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা এখনো পাইনি।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, বর্তমানে তিস্তা নদীর ১০টি পয়েন্টে ভাঙন চলছে। এর মধ্যে কালির মেলা ও রামহরি এলাকায় ভাঙন বেশি হয়েছে। আমরা জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধে কাজ করছি। সমস্যা হচ্ছে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেলেও ভাঙছে, পানি কমলেও ভাঙছে।
জুয়েল রানা/আরকে