হোগলাপাতার হস্তশিল্পে হাজারো মানুষের ভাগ্য বদল
হোগলাপাতা, পাট ও বাঁশ দিয়ে তৈরি হস্তশিল্পে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার হাজারো মানুষের ভাগ্য বদল হয়েছে। হোগলা পাতার কারুশিল্প বদলে দিয়েছে উপজেলার কর্মহীন মানুষের জীবন। গ্রামের হতদরিদ্ররা হোগলা পাতার দড়ি দিয়ে বাহারি হস্তশিল্প তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। শুধু তাই নয়, এসব পণ্য ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ২৮টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
বেলাব উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে বিন্নাবাইদ ইউনিয়নের জুহুরিয়া কান্দা গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোর প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের হোগলাপাতার কারুশিল্প তৈরির কারখানা।
উপজেলার একটি প্রত্যন্ত ইউনিয়ন বিন্নাইবাদ। এক সময় দরিদ্রতা ছিল এই ইউনিয়নের মানুষের জীবনসঙ্গী। পুরুষেরা প্রতিদিন কাজ করলেও নারীরা ঘরের কাজ শেষে অবসর সময় কাটাতেন। কিন্তু বর্তমানে ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের সেই চিত্র বদলে গেছে। গ্রামগুলোর প্রায় প্রতিটি বাড়িতে হোগলাপাতার হস্তশিল্প তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন নারীরা। তাদের হাতে তৈরি পণ্য ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্তত ২৮টি দেশে যাচ্ছে। উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামের কারখানা মালিকরা নারী-পুরুষদের কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ঘরে ঘরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন।
হোগলাপাতার রয়েছে নানা ধরনের নাম। বাংলায় হোগল, হোগলাপাতা ও ধারী পাতা নামে পরিচিত হলেও ইংরেজিতে এটাকে ক্যাট টেইল বা বিড়ালের লেজ বলা হয়। সাধারণত ৫ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার এই হোগলাপাতা রোদে শুকিয়ে বিশেষ কায়দায় এই পাতা পেঁচিয়ে প্রথমে দড়ি বানানো হয়।
উদ্যোক্তারা জানান, পণ্যে ব্যবহৃত হোগলাপাতার দড়ি নোয়াখালী ও দ্বীপ জেলা ভোলা থেকে আনা হয়। পরে নিজ নিজ এলাকায় দক্ষ কর্মীদের মাধ্যমে ফরমেট অনুযায়ী তৈরি পণ্য ক্রেতাদের সরবরাহ করা হয়।
শুধু হোগলাপাতাই নয়, এ এলাকার হস্তশিল্প কারখানাগুলোতে বাঁশ ও পাটের হস্তপণ্যও তৈরি হচ্ছে। হোগলাপাতা, বাঁশ, ও পাটসহ বিভিন্ন কাঁচামাল দিয়ে তৈরি হস্তশিল্পগুলো ফুলের টব, কিচেন বাস্কেট, টিস্যু বক্স, পেট বাস্কেট, ক্যারেট, শপিং বাস্কেট, ফ্লোর মেটসহ কুটির শিল্পের নান্দনিক সব জিনিসপত্র। উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন উৎসবে দেশিয় তৈরি এসব পণ্য প্রদর্শন ও সহজলভ্য করা গেলে পণ্য বিক্রির পাশাপাশি আয় বৃদ্ধি পাবে।
বেসরকারি রপ্তানিনির্ভর শিল্পগুলোর মালিকরা বলছেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে বিদেশি উৎসবে দেশি পণ্যের অংশগ্রহণ সহজ হবে, অর্ডার বাড়ানোর পাশাপাশি পণ্য রপ্তানি করেও আশানুরূপ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে।
জুহুরাকান্দা গ্রামের শফিকুল বলেন, আমাদের যতটুকু মূলধন আছে তা দিয়েই আমার বড় ভাই এলাকায় এই কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বেশি মালের অর্ডার পেলে তখন আমাদের হিমশিম খেতে হয়। অর্ডার অনুযায়ী মাল তৈরির জন্য অতিরিক্ত মালামাল কিনতে গিয়ে কর্মচারীদের মজুরি ঠিক সময়ে আর দেওয়া সম্ভব হয় না। সরকার এ শিল্পের দিকে নজর দিয়ে মালিকদের আর্থিকভাবে সহায়তা বা স্বল্প সুদে ঋণ দিলে অত্র অঞ্চলে এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটতো।
সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এ কারুশিল্পের কাজ করার সুযোগ থাকায় জুহুরিয়া কান্দা গ্রামের অধিকাংশ নারী ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে আজ স্বাবলম্বী। হোগলাপাতা আড়াআড়ি ও দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে পছন্দের কারুপণ্যের রূপ দেওয়া হয়। এখানকার অধিকাংশ মহল্লা ও কারখানায় দলবেঁধে চলে কারুপণ্য তৈরির কাজ। কারুপণ্য কারিগররা তাদের শৈল্পিক বিন্যাসের মাধ্যমে ক্রেতাদের অর্ডার অনুযায়ী তৈরি করছেন মনোমুগদ্ধকর হস্তপণ্য।
খালেদা আক্তার নামে এক গৃহবধূ জানান, তিন সন্তানসহ পাঁচজনের সংসার তাদের। শুধু স্বামীর কৃষি কাজে তাদের সংসার চলতো। তাই বাধ্য হয়ে গ্রামের অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে চার মাস আগে হোগলাপাতা দিয়ে ঝুড়ি বানানোর কাজ শিখে ওভারটাইম করেন। সে মাসে ৯০০০ টাকার মতো পান। বর্তমানে তার সংসার খুব ভালো চলছে।
শারমিন নামে অপর এক কারুশিল্প শ্রমিক বলেন, সংসারের অভাব দূর করতে আমি দুই মাস আগে এই কাজে যোগ দেই। এতদিন বাবাই সংসার চালাতেন। মাস তিনেক আগে তিনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছেন। অসুস্থ বাবার চিকিৎসার ব্যয় ও সংসারের বোঝা এসে পড়ে আমার মাথায়। বাধ্য হয়ে আমি এই কাজের যোগ দেই সবেমাত্র কাজে যোগ দিয়েছি তাই মাসে ৫ হাজার টাকা পাই। এ টাকায় বাবার ওষুধ ও সংসারের খরচ চলে না। অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছি।
এখানকার অধিকাংশ কারখানায় পেশাদার কারুশিল্পীদের দ্বারা মানসম্মত ও আধুনিক নকশায় হোগলাপাতার ঝুড়ি, ফুলের টব, লণ্ড্রি বাস্কেট, কিচেন বাস্কেট, ওয়াল মেট, ডাইনিং ও ফ্লোরমেট থেকে শুরু করে পাপসসহ নানা ধরনের কারুশিল্প তৈরি করা হয়।
শেরপুর জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নয়ন বাঁশফোর ঢাকার সাভারে কাজ শিখে বছরখানেক ধরে এই কারখানায় কাজ করছেন। সব মিলিয়ে তিনি মাসে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা আয় করতে পারে। এখানে তার হাত খরচ বাবদ যত সামান্য টাকা খরচ হয়। বাকি টাকা সে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। এতে তার সংসার ভালোই চলে যায় বলে জানায়।
মাপ ও সাইজ ঠিক রাখার জন্য অধিকাংশ কারুপণ্য বানাতে লোহা ও জিআই তারের ডাইস ব্যবহার করা হয়। প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে তৈরি এ সকল কারুশিল্প পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বৈদেশিক বাজারে এর চাহিদাও ব্যাপক। এখানকার তৈরি কারুপণ্য সাপ্লায়ারদের হাত হয়ে আমেরিকা, কানাডা, চীন, জাপান, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় ২৮টি দেশে রপ্তানি হয়।
সাইফুল নামে এলাকার এক তরুণ কাজ করছেন এই হস্তশিল্প কারখানায়। ঢাকার মিরপুর থেকে কাজ শিখে সেখানে তিন বছর কাজ করেন। পরবর্তীতে এলাকায় যখন হস্তশিল্পের কারখানা গড়ে উঠলো তখন তিনি তার নিজ এলাকায় ফিরে আসেন।
হোগলাপাতা খুব সহজেই পচনশীল হওয়ায় এতে পরিবেশ দূষণের কোনো সম্ভাবনা নেই। বিশ্বজুড়ে আজ পরিবেশ দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সি-গ্রাস বা সমুদ্রের তীরের ঘাস অর্থাৎ হোগলাপাতা, তালপাতা, খেজুরপাতা ও গোলপাতা জাতীয় জিনিসের তৈরি পণ্য। পরিবেশবান্ধব পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারিত হওয়ায় হোগলাপাতার পণ্যের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শিপন মোল্লা নামে এলাকার একজন উদ্যোক্তা বলেন, আমার এই কারখানায় বর্তমানে হাজার দুয়েক মানুষ কোনো না কোনোভাবে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত হয়েছি আবারও পরিবর্তনও করেছি। কোনো ব্যবসায়ই স্থায়ী হতে পারেননি। তবে বর্তমানে আমি হস্তশিল্প কারখানা গড়ে তুলে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারায় অনেকটা আত্মতৃপ্তিতে আছি।
বিন্নাবাইদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুলতানা রাজিয়া স্বপ্না বলেন, সমাজের সকল বেকার যুবক, স্বামী পরিত্যক্ত নারী, অসহায় ও অসচ্ছল মানুষেরা যেন এ কুটির শিল্পে কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারে সেদিকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) নরসিংদীর সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, আমরা মূলত নরসিংদীর বেকার ও তরুণদের নিয়ে কাজ করছি। প্রতি বছর নরসিংদীর সম্ভাবনাময় ১৫০ জন তরুণ উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। সেক্ষেত্রে বিসিক সে সকল উদ্যোক্তাকে বিনা জামানতে ব্যবসার জন্য ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়। এছাড়া কিছু শর্ত সাপেক্ষে আমরা ৫-১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়ে থাকি।
আরএআর